প্রকৃতির কোলে শাটলের ক্যাম্পাস

চবি প্রতিনিধি | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মোহনীয় এক ক্যাম্পাসের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। পুরো ক্যাম্পাস যেন সবুজের ছাদরে মোড়ানো। ক্যাম্পাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের বিশাল সমাহার। সকালে শাটলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসের। শাটলের বুকে-পিঠে চড়ে ক্যাম্পাসের পথে পা বাড়ায় হাজারো শিক্ষার্থী।
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার জার্নি শেষে শিক্ষার্থীরা শাটল থেকে নামতেই যেন আড়মোড়া ভাঙে ক্যাম্পাসের। প্রাণ ফিরে আসে ক্যাম্পাসজুড়ে। নিরব-নির্জীব ক্যাম্পাস নিমিষেই ফিরে পায় প্রাণ। শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে হয়ে উঠে মূখর। দেশের তো বটেই সারা বিশ্বেও বতর্মানে একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সবুজে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়। হাটহাজারীর ফতেহপুরের জোবরা গ্রামে পাহাড়ঘেরা ২৩শ একর সমতল, উঁচু-নিচু পাহাড়ি ভূমিতে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়।
মাত্র চারটি (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি) বিভাগে ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যাত্রালগ্নে
শিক্ষক ছিলেন ৮ জন। প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান (এ আর) মল্লিক। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৫৬ শেষ করে ৫৭ বছরে পদার্পণ করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রালগ্নের চারটি বিভাগের স্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র, অধিভুক্ত অনুষদ ১টি, অধিভুক্ত ইনস্টিটিউট ১টি এবং অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ২৫টি। মোট শিক্ষার্থী ২৭ হাজার ৫৫০ জন। মোট শিক্ষক ৯০৬ জন। কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন প্রায় ২ হাজার।
আবেগের শাটল : শহর থেকে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৯৮১ সালে চবিতে প্রথম শাটল ট্রেন চালু হয়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম সুবিধা নেই। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে শাটলের ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা থাকলেও কয়েক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে সবুজ ঘেরা চবি ক্যাম্পাসই এখন বিশ্বে একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের বয়ে আনা এ শাটল যেন কালের সাক্ষী ও বহু ঐতিহ্যের ধারক। ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে পুরোটা সময়জুড়ে গানে-গানে মুখর থাকে শাটলের সবকয়টি বগি। এটাকে বলা হয় চলন্ত ক্যাম্পাস। দিনের পর দিন বগি চাপড়িয়ে গানে-গানে শাটল মাতিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরাই। রক-র‌্যাপের পাশাপাশি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, প্যারোডি, পাহাড়ি ও বাংলা সিনেমার গানসহ এমন কোনো গান হয়তো বাদ নেই, যা শাটলে গাওয়া হয় না। এ শাটলে বগি চাপড়িয়ে গান গেয়ে ইতোমধ্যে দেশবরেণ্য তারকার খেতাবও কুড়িয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন কণ্ঠশিল্পী নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া ও এস আই টুটুলের মতো দেশ বরেণ্য শিল্পীর নাম।
সমাবর্তন মাত্র চারবার : ৫৬ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ডিগ্রির সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে নেওয়ার সুযোগও হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর। এ নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছে সাবেক শিক্ষার্থীরা।
নিরব চাকসু : বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬ বছরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হয়েছে মাত্র ছয়বার। প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে এবং প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস আবদুর রব। সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তখন ভিপি নির্বাচিত হন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা নাজিম উদ্দিন, জিএস নির্বাচিত হন আজিম উদ্দিন ও এজিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর রহমান শামিম। ওই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭ জন। একই বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনে হেরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্র ঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান খুন হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাকসুর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তৎকালীন প্রশাসন। বন্ধ হয়ে যায় চাকসুর হল সংসদের কার্যক্রমও।
শিক্ষার্থীদের কথা : রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নিজাম উদ্দীন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে অবকাঠামো দিক থেকে। কিন্তু গবেষণায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর ক্যাম্পাসে টিএসসি না থাকায় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কগুলো ভালো হচ্ছে না। এছাড়া ক্লাসের বাহিরেও শিক্ষার্থীদের অনেক কাজ থাকে যেগুলো একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত জ্ঞানী হতে সহযোগিতা করে থাকে। ইতিহাস বিভাগের সাবেক আরেক শিক্ষার্থী বেলায়েত হোসেন বলেন, পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এবং শহরের দূরে হওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী থাকতে হয় শহরে। যার কারণে ক্লাসের সময় ক্যাম্পাস জমজমাট থাকে অন্য সময় থাকে নিরব। সব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে থাকতে পারলে তারা অনেক কিছু করতে পারত। এখন আসা যাওয়াতেই অনেক সময় চলে যাচ্ছে।
অর্জন : সময়ের পালাবদলে ৫৭ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে এই বিদ্যাপীঠ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে উচ্চশিক্ষার পঠন-পাঠনের পাশাপাশি অসংখ্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদসহ সচেতন মানুষ তৈরি করে দেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ৫৬ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে অনেক রথী-মহারথীর। বিশ্বখ্যাত ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ইমিরেটাস জামাল নজরুল ইসলাম এর মধ্যে অন্যতম। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। দেশের একমাত্র নোবেল জয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার হাতে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রাম থেকেই যাত্রা শুরু করে।
৫৬তম দিবসে বর্ণাঢ্য আয়োজন : ৫৬ বছর পেরিয়ে ৫৭ বছরে পা দিতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনুষ্ঠানসূচি তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। দিনব্যাপী আয়োজনে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বর থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায় কেক কেটে আলোচনা সভা শুরু। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ।
চাকসুর সাবেক নেতৃবৃন্দের শুভেচ্ছা : এদিকে চাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক এমপি মজহারুল হক শাহ চৌধুরী, সাবেক জিএস জমির চৌধুরী, সাবেক ভিপি মো. নাজিম উদ্দিন এবং জিএস আজিম উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে এক যৌথ বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারসহ সকলকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির পঞ্চম সমাবর্তন মার্চে : উপাচার্য
পরবর্তী নিবন্ধনগরীর থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট আওয়ামী লীগের সম্মেলন ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত