জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনযাপন ছিল সাধারণ, কিন্তু পোশাক-আশাকে ছিলেন রুচিস্নিগ্ধ, ছিলেন আপাদমস্তক ফ্যাশনসচেতন। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সুঠাম দেহের সমন্বয়। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যাঁর গড়নে। গায়ের সাদা পাঞ্জাবি, কালো কোট, এমনকি জুতোতেও ছিল রুচির ছোঁয়া। ঘরে-বাইরে যে পোশাকেই তাঁকে দেখা যেত, সবাই দেখে মুগ্ধ হতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি আকর্ষণ করতেন সবাইকে। ফ্যাশন ডিজাইনরা বলেন, ‘কেবল পোশাক-আশাক নয়, বরং ব্যক্তিবৃত্তের পরিসীমায় সংযোজিত গুণাবলির মিশ্রণে তিনি হয়ে উঠতেন অসাধারণ। স্টাইলিস্ট ব্যক্তিত্বেও নিজের পরিচয়কে এ যাবৎকালের টেন্ড হিসেবে পরিস্ফুটিত করেছেন এই বিশ্বনেতা।’
বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষদের জাগ্রত করেছিলেন এবং তাদের সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। নিজের দেশ, দেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে লালন করতেন। তাই তার ব্যক্তিত্ব ও পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে স্বদেশীয় ছাপ স্পষ্ট।
ড. মোহাম্মদ হান্নান ‘বঙ্গবন্ধুর পোশাক : পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পোশাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ একটি বই লিখেছেন। এছাড়া অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ফ্যাশন সচেতনতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার বদরুন নাহার রঙী, চিত্রশিল্পী অভিজিত চৌধুরী, সাংবাদিক শেখ সাইফুর রহমান, মোহসীনা লাইজু প্রমুখ। তবে আন্তর্জাতিক এক ফ্যাশন ব্যক্তিত্ব, জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত বিবি রাসেল বঙ্গবন্ধুর পোশাকের অনন্যসাধারণ মূল্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে বিবি রাসেল তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর পোশাকই যেন ছিল বাঙালিয়ানার ‘স্টেটমেন্ট’। বঙ্গবন্ধুর পোশাক বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব করে। বিবি রাসেলের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কিছু অংশ এখানে ধরলাম : “বাঙালি নারীর সর্বজনীন পোশাক যে শাড়ি- সে ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু বাঙালি পুরুষের সর্বজনীন পোশাক কী- এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক দেখা যায়। আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর পোশাকই হতে পারে বাঙালি পুরুষের আনুষ্ঠানিক ‘ড্রেস কোড’। বাইরের জন্য কেবল নয়, ঘরেও বঙ্গবন্ধু যা পরতেন, সেখানে দেশীয় আবহ স্পষ্ট। তার পোশাকই যেন ছিল বাঙালিয়ানার ‘স্টেটমেন্ট’। আমরা যখন বেড়ে উঠি, সেই ষাটের দশকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোশাক এবং ফ্যাশন সচেতনতা ও স্বাতন্ত্র্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী শেখ মুজিবকে যে কোনো পোশাকই মানাতো। এখনও বিভিন্ন আলোকচিত্রে আমরা দেখি, বিদেশ সফরে গিয়ে তিনি স্যুট বা ম্যান্ডারিন কলার কোট পরেছেন। আবার বাসায় আটপৌরে লুঙ্গি ও হাফ হাতা গেঞ্জি পরা ছবিও দেখা যায়। সবকিছু ছাপিয়ে তার নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয়েছে সেই ষাটের দশকেই- সাদা রঙের ঢোলা পাজামা, খাটো ঝুলের পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা কালো কোট। এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে ব্যাকব্রাশ করা চুল ও মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। বঙ্গবন্ধুর ফ্যাশন সচেতনতা বোঝার জন্য তার একই ফ্রেমের চশমা ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।”
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘খোকা’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠা এবং পরবর্তীকালে ‘জাতির পিতা’ হওয়ার নানা ধাপে তিনি দেখিয়েছেন ব্যক্তিত্ব ও রুচির পরম্পরা। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারের ব্যক্তিসত্তা বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য। শেখ সাইফুর রহমানের মূল্যায়ন চমৎকার। তিনি লিখলেন, ‘কেবল পোশাক-আশাক নয়, বরং ব্যক্তিবৃত্তের পরিসীমার পরতে সংযোজিত গুণাবলি তাঁকে অনন্য স্টাইলিস্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তিনি যেটাই পরেছেন, সেটাতে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর পোশাক নিয়ে আলোচনায় তাঁর অসংখ্য ছবি বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় নানা ধরনের পোশাক পরিধানের দৃষ্টান্ত। একেবারে আটপৌরে বাঙালি থেকে কেতাদুরস্ত রাষ্ট্রপ্রধান স্থান, কাল আর উপলক্ষবিশেষে বদলেছে তাঁর পোশাক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্টাইলে ছিল দুটো সিগনেচার বিষয়-ব্যাকব্রাশ করা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা। এর সঙ্গে তিনি যেটাই পরেছেন, সেটাকে চমৎকারভাবে ক্যারি করায় প্রতীয়মান হয়েছে একজন স্টাইলিস্ট ব্যক্তির প্রতিকৃতি। সেই দৃশ্য হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী, অনুসরণীয়। অবশ্য দেশনেতা, বিশ্বনেতার বাইরে তিনি একজন সত্যিকারের গৃহী, পরিবারপ্রধান, তাঁর পোশাকে, বাৎসল্যে, আপনজনের সান্নিধ্য উপভোগে পরিতৃপ্তির প্রশান্তিতে সেটা বারবার ফুটে উঠেছে।’
বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা বিশিষ্টজনদের মতে, বঙ্গবন্ধু সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরতেই পছন্দ করতেন। সাদা হলো শান্তি, নিরাপত্তা, আলো, পবিত্রতা, সততা, বিশুদ্ধতা, জ্ঞান, বিদ্যা, বিশুদ্ধতা ও ধার্মিকতার প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সব গুণাবলী ধারণ করতেন এ পোশাকে। পাঞ্জাবি-পাজামা একটু ঢিলেঢালা থাকত, পাঞ্জাবির হাতা একটু বড়। এর কারণ হলো তিনি একটু ফোল্ড বা ভাঁজ অর্থাৎ গুটিয়ে রাখতেন, কাপড় ছিলো সুতি।
গণভবনে শেখ কামালের গায়েহলুদের পর সেদিনের সন্ধ্যায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির ছাদে তোলা পাভেল রহমানের ছবিতে আমরা তাঁকে দেখি চেক লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জিতে। হাতে ধরা পাইপ মুখে ঠেকানো। চেয়ারের ওপর দুই পা ভাঁজ করে ফুলবাবু হয়ে একটু সামনে ঝুঁকে বসা। টেবিলের ওপর ছাইদানি। এই ছবি নিয়ে পাভেল রহমানের মনোগ্রাহী স্মৃতিচারণা আছে।
বাঙালি মধ্যবিত্তের পরিবারপ্রধানের এই আটপৌরে রূপ আমাদের সময় খুবই সাধারণ ছিল। লুঙ্গি আর গেঞ্জিতে বাঙালি সত্যিই স্বচ্ছন্দ। ফলে, বঙ্গবন্ধুকে নানা সময়ে দেখা গেছে তাঁর প্রিয় চেক লুঙ্গির সঙ্গে কখনো হাফহাতা শার্ট, কখনো পাঞ্জাবি বা কখনো স্রেফ স্যান্ডো বা হাফহাতা। বাসায় তিনি দুই ধরনের গেঞ্জিই পরতেন। একসময় এগুলোকে বলা হতো হোসিয়ারি।
ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনেক আলোকচিত্র পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি লুঙ্গি পরেছেন। তার মানে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের পোশাকও ছিল তার একান্ত আপন। সেই লুঙ্গি নিয়েও কিছু কথা আছে। তার লুঙ্গি পরা ছবিগুলো আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, প্রায় সবক’টিতে তিনি চেক লুঙ্গি পরেছেন। এর মধ্য দিয়েও তার নিজস্বতা বোঝা যায়। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা যদি বঙ্গবন্ধুর মতো লুঙ্গি পরায় অভ্যস্ত হতেন, তাহলে আমাদের লুঙ্গি শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যেত।
একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধুর লুঙ্গিপ্রীতি কেমন ছিল! বঙ্গবন্ধু যে শুধু দেশ ও দশের কথা ভেবেছেন তা তো নয়। অতি সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাপন। তাঁর পোশাক, আহার সবকিছুতেই ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানা। একবার আলজেরিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীদের কাছে ফরেন অফিস থেকে চিঠি এলো- আপনারা লুঙ্গি এবং মেসওয়াক নিতে পারবেন না। কিন্তু প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী লুঙ্গি ছাড়া ঘুমাতে পারেন না। তাহলে উপায়? তিনি ছুটলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। সব শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে নিবি নিবি। আমিও কি লুঙ্গিছাড়া ঘুমাইতে পারি নাকি। আমিও তো লুঙ্গি নিমু’। গাফ্্ফার চৌধুরী সেবার বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি আলজেরিয়া গিয়ে দেখলেন, বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যি লুঙ্গি নিয়ে গিয়েছেন এবং হোটেলে লুঙ্গি পরেই আছেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যা যা প্রিয় ছিল, তাই এই দেশের সকল মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ পোশাক ছিলো ৬ বোতামের কালো কোট। যে কোটটি পরবর্তীকালে ‘মুজিব কোট’ নামে বেশি পরিচিতি পায়।
বঙ্গবন্ধু ঠিক কত সাল থেকে কালো কোট পরা শুরু করেছিলেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের মতে, আগরতলা মামলার সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু এই কালো কোট পরা শুরু করেন।
মুজিব কোট নিয়ে একটা আখ্যান চালু আছে। সেটি হলো : এক নেতাকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা আপনি মুজিব কোট পড়েন কেন?” নেতা মুজিব কোটের আসল রহস্য জানতেন না। তাই তিনি স্বভাবসুলভ জবাব দিয়েছিলেন, “এটা বঙ্গবন্ধু পরতেন, তাই আমিও পরি। এটা একটা আদর্শ।”
আসলে এই কোট পরার পেছনে রয়েছে এক গভীর চিন্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র তার সহপাঠী তাজউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক কাছ থেকে দেখলেন, কথাও বললেন দীর্ঘক্ষণ। কথা শেষে ওঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন তার কালো কোটটি গায়ে জড়াচ্ছিলেন তখন ওই ছাত্র লক্ষ্য করলেন কোটে ৬টি বোতাম রয়েছে। যা এ ধরনের অন্য কোটের বোতামের চেয়ে কম। এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কোটের বোতাম ৬টি কেন?’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন প্রশ্ন এর আগে আমাকে আর কেউ করেনি। তুই প্রথম। এই ৬টি বোতাম আমার ঘোষিত ৬ দফার প্রতীক।’
এই মুজিব কোটে ছিলো ৬টি বোতাম। মুজিব কোটের ৬ বোতাম মানেই শেখ মুজিবের ৬ দফা। স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে শেখ মুজিবের গায়ের কোটটি মুজিব কোট হিসেবে তেমন খ্যাতি লাভ করেনি। কালো হাতাকাটা এই বিখ্যাত কোটটি তখনও লাভ করেনি কালজয়ী কোনো নাম।
ফ্যাশন ডিজাইনার বদরুন নাহার রঙী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের বৈশিষ্ট্য ছিল কালো রঙের কোটে ছয়টি বোতাম। কালো হচ্ছে বিপদ, মৃত্যু, দুর্বলতা ও অশুভশক্তির প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তার এ কালো রঙের মাঝে ফুটিয়ে তুলেছেন বিপদের মোকাবেলা করা, মৃত্যু ভয়কে পেছনে ফেলে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা, দুর্বলতাকে পায়ে মাড়িয়ে রুখে দাঁড়ানো, অশুভশক্তিকে পরাজিত করে সত্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।’
এভাবে বঙ্গবন্ধুর ফ্যাশনের মধ্যে রয়েছে ৪১ সাইজের জুতো; তাঁর চুলের বেকব্রাশ আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, টুপি, লাল রঙের মাফলার এবং বৈচিত্র্যময় পাইপ। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের চিত্র ফুটে উঠত আয়েশি ভঙ্গিমার পাইপে তামাক সেবনেও। শুধু রাজনৈতিক দর্শন নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবনযাপনও আমাদের জন্য বড় আদর্শ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী