পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি

সার্ভার ডাউনেই যত সমস্যা ।। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনে ‘ঝামেলা’ পিছু ছাড়েনি

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৫ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় পরিচয়পত্র, অনলাইন জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট তৈরি ও সংশোধন নিয়ে মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। মাসের পর মাস ঘুরেও পাওয়া যায় না জন্মনিবন্ধন, সংশোধন হয় না পরিচয়পত্র। পাসপোর্ট পাওয়ার ভোগান্তিও অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, এমনকি রাতেও কম্পিউটারের দোকান, অনলাইন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দোরগোড়া, কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদে অপেক্ষমাণ মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। রোজার দিনে এপ্রিলের তীব্র গরমের মাঝে মানুষকে উপরোক্ত তিনটি সেবার পেছনে ছুটতে হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাসপোর্ট করতে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগছে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য লাগে অনলাইন জন্মনিবন্ধন। যাদের পরিচয়পত্র নেই তাদের পাসপোর্ট করতে অনলাইন জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিষয়টি জরুরি। জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টের মতো স্পর্শকাতর জিনিসের সাথে অনলাইন জন্মনিবদ্ধন থাকাটা যৌক্তিক। বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশি হওয়ার অপতৎপরতা ঠেকাতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু জরুরি এই সেবাগুলো পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত কম্পিউটার না থাকা, সার্ভারে যখন-তখন সমস্যা, রাতে-দিনে চেষ্টা করেও সার্ভারে প্রবেশ করতে না পারা, সাধারণ মানুষের কম্পিউটার জ্ঞানের অভাবসহ নানা প্রতিকূলতায় পুরো বিষয় জনদুর্ভোগের কারণে পরিণত করেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ নানা কৌশলে জাতীয় পরিচয়পত্র, অনলাইন জন্মনিবন্ধন ও পাসপোর্ট করতে সক্ষম হয়েছে। সংঘবদ্ধ দালাল ও প্রতারকচক্র নানা কৌশলে এবং মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই প্রক্রিয়া ঠেকাতে সরকারকে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে তারা স্বীকার করেন।
যেকোনো কাজের শুরুতে প্রয়োজন হয় অনলাইন জন্মনিবন্ধন। কিন্তু এই জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের সমস্যা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে জন্মনিবন্ধন করা যাচ্ছে। একজন মাত্র কম্পিউটার অপারেটর দিয়ে একেকটি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের কয়েক লাখ মানুষের জন্মনিবন্ধনের কাজ করতে হচ্ছে। শুধু জন্মনিবন্ধনের জন্য কোনো লোকবল পদায়ন করা হয়নি। ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড অফিসের সচিবকেই মূলত স্বাভাবিক কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে জন্মনিবন্ধনের কাজ করতে হয়। এতে করে অনেক সময় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থেকেও একজন মানুষ জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না। বিশেষ করে সার্ভার ডাউন থাকলে পরিস্থিতি হয় ভয়াবহ।
জন্মনিবন্ধন করার সময় কোনো কারণে নামে সামান্য ভুল হলে তা সংশোধন করাতে হয় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে। ইউনিয়ন অফিস কিংবা ওয়ার্ড অফিসে সংশোধন করার সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে ফাইল নিয়ে ছুটতে হয় ডিসি কিংবা ইউএনও অফিসে। সেখানে নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছে গিয়ে সবকিছুর প্রমাণ দেয়ার পর তিনি অনলাইনে অনুমোদন দিলেই কেবল সংশোধন হয়। কোনো কারণে ভুল হলে আবারও ছুটতে হয়। এভাবে ছোটাছুটি করে জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে উঠছে। আবার শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য শুরুতে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন করতে হয়।
জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করার পর জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। তা-ও অনলাইনে। কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে আবেদন করতে হয়। আবেদনের কপি সংগ্রহ করে জমা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তার অফিসে। সেখানে দিনের পর দিন ধর্না দিয়েও পাওয়া যায় না পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্র সংশোধনের ঝক্কি আরো বেশি বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধু আবেদন করে পরিচয়পত্র সংশোধন হয় না। মাসের পর মাস ঘুরেও পরিচয়পত্র সংশোধন না হওয়ার হাজার হাজার রেকর্ড রয়েছে।
পরিচয়পত্র তৈরির পর পাসপোর্ট করতে গেলে নতুন ঝক্কি। পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয় অনলাইনে। কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করে পাসপোর্ট অফিসে জমা দেয়ার সময় নতুন ঝামেলা। সার্ভার ডাউন হলে কাজ হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে না পারার ঘটনা প্রাত্যহিক। আবার পরিচয়পত্র কিংবা জন্মনিবন্ধনের সাথে নামের বা ঠিকানার কোনো পার্থক্য থাকলে তৈরি হয় নতুন জটিলতা। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ‘বিশেষ কথামালা যুক্ত করে’ এফিডেবিট করতে হয়। নির্দিষ্ট বাক্যগুলো লেখা না থাকলে ওই এফিডেবিট গ্রহণ করা হয় না। আবার ঠিকানা পরিবর্তন হলে পুলিশি ভেরিফিকেশনের জটিলতা তৈরি হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনেও পদে পদে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সেবা দেয়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে বড় অগ্রগতি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা, প্রযুক্তির বিড়ম্বনা ও কিছু মানুষের কারণে জরুরি তিনটি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সেবাগুলো যাতে সহজে মানুষ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন জন্মনিবন্ধন নিয়ে মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করেন। বিষয়টি কী করে সহজ করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য তিনি নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
জেলা নির্বাচন অফিসের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদেরকে কিছু সিস্টেম অনুসরণ করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ থাকে না। অনলাইনের ব্যাপারটি পুরোপুরি সার্ভার নির্ভর। সার্ভারে গোলমাল করলে আমাদের কী করার আছে?
পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা সার্ভার সংকটের কারণে মাঝেমধ্যে সমস্যা হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে তাদের কিছু করার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, পাসপোর্ট পুলিশ ভেরিফিকেশনে যাবে। এটির কোনো বিকল্প নেই। পাসপোর্ট নবায়নের সময়ও অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন দেখা দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধরোজায় স্কুল-কলেজের ক্লাস ২০ এপ্রিল পর্যন্ত