পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের

এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতি ।। অবহিতকরণ চিঠিতে জানাল শিক্ষাবোর্ড

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৬ আগস্ট, ২০২২ at ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ

২০২১ সালে প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতির ঘটনায় সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার কর্তৃক ২৫ জুলাই স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। এর আগে ২০ জুলাই জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানায় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। শাস্তি হিসেবে ওই কর্মকর্তার (সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট) বেতন গ্রেড বিদ্যমান গ্রেডের এক ধাপ নিম্নস্তরে অবনমন করা হয়েছে। যা এক বছরের জন্য কার্যকর থাকবে। তবে ফলাফলে অসঙ্গতির ঘটনায় তদন্তে দায়ী বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার ভূক্ত। এই বিষয়টিও চিঠির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে শিক্ষাবোর্ড। শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা হওয়ায় সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার রয়েছে শিক্ষাবোর্ডের। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে নিজস্ব এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডার ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেষণে নিয়োগকৃত কর্মকর্তা হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই শিক্ষাবোর্ডের। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
তবে এ ঘটনায় অদ্যবধি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন ভূমিকাকে রহস্যজনক হিসেবে দেখছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা শাখার। আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ শাখার প্রধান। সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অধীনস্ত একজন কর্মকর্তা। ফলাফলের বিষয়ে তিনি কেবল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নির্দেশনাই পালন করেছেন। সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানও এমন দাবি করেছেন। বোর্ড কর্তৃক ব্যাখ্যা তলবের জবাবে তিনি কেবল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের নির্দেশনা মেনে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। বোর্ডের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে দায়ী করা হয়। ফলাফলে অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার নেপথ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের দায় ও ব্যর্থতা উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। অথচ এ ঘটনায় সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের শাস্তি হলেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার আজাদীকে বলেন, ঘটনাটি আমি দায়িত্ব গ্রহণের আগেকার সময়ের। তবে এ ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে ব্যবস্থা নিয়েছি। আর ব্যবস্থা গ্রহণ পরবর্তী সেটি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।
উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। ওই দিন দুপুরে ফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর প্রদর্শনে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রশ্নের মুখে পড়ে বোর্ডের ভাবমূর্তিও। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের সাথে সম্পৃত্ত শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। ফল প্রকাশের পরদিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) থানায় জিডির পাশাপাশি এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে প্রধান করে গঠিত কমিটি গত ৩ মার্চ শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির অপর দুই সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম সাজেদুল হক ও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদার। ফলাফলে অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার নেপথ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের দায় ও ব্যর্থতা উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে গত ৪ এপ্রিল দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘ব্যর্থতা ও দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের/এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠায় শিক্ষাবোর্ড। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি মাধ্যমিক-২ শাখার যুগ্নসচিব খালেদা আখতারের স্বাক্ষরে গত ১৫ মার্চ এ নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে একই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে আরো ১৬ দিন পর। সরকারি মাধ্যমিক-২ শাখার উপসচিব আলমগীর হুছাইন কর্তৃক ১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথের কাছে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা তলব করা হয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে দেয়া মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অসঙ্গতি সংক্রান্ত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ‘মোট নম্বর ২০০, পেল ২১৮! দুপুরে প্রাপ্ত নম্বর পাল্টে গেল সন্ধ্যায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে ‘শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত কমিটি, থানায় জিডি’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উল্লিখিত প্রতিবেদনের বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে নিম্মরুপ মন্তব্য করে- ‘তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্য সম্পাদন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ১১/০২/২০২২ ইং তারিখ বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০:১০ টা পর্যন্ত ফলাফল প্রসেসিং রুমের কম্পিউটারের টেবুলেশন অনিরাপদ রাখায় ফলাফল তৈরিতে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা অনাকাক্সিক্ষত। ফলাফল সংশোধনের বিষয়টি বোর্ডের নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং আইটি টিমের সদস্যরা নিজেরাই সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে দু’ধরণের নম্বরফর্দ প্রাপ্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। যেহেতু পরীক্ষার ফলাফল তৈরি সংক্রান্ত সকল দায়-দায়িত্ব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের, সেহেতু এর সম্পূর্ণ দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপর বর্তায়।’ বর্ণিতাবস্থায় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অসঙ্গতি এবং এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির মতামতের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় চিঠিতে। তবে ব্যাখ্যা প্রদানে চিঠিতে সময়সীমাও উল্লেখ করেনি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক ভাবে এ ধরনের ব্যাখ্যা তলবের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করে দেয়া থাকে। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বেলায় মন্ত্রণালয় সেটিও করেনি। যার কারণে এটিকে দায়সারা ব্যাখ্যা তলব হিসেবে অভিহিত করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কী না, সেটিও নিশ্চিত নয় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলবের চিঠির অনুলিপি দেয়া হয় শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে। ওই সময় বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান বোর্ড সচিব প্রফেসর আবদুল আলীম। জানতে চাইলে তিনি গতকাল আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছিল, সেটির অনুলিপি পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এর জবাব দিয়েছিলেন কী না, সে বিষয়ে আমি অবগত নই। কারণ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ব্যাখ্যা প্রদান সংক্রান্ত কোন চিঠির অনুলিপি আমি পাইনি।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ৫ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকা কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই আছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিনশ করেও হার
পরবর্তী নিবন্ধতিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আজ