পবিত্র ঈদ-উল আজহা ও সাম্য-বৈষম্যহীন ধর্মদর্শন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ২৮ জুন, ২০২৩ at ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বজনীন আশংসিত সত্য যে; পবিত্র ইসলাম ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত। এই অবশ্য পালনীয় রোকনসমূহের মধ্যে রোজা পালন এবং হজ্ব আদায়ের সাথে সম্পর্কিত ঈদউল ফিতর ও ঈদউল আজহার তাৎপর্য অপরিসীম। পুরো একটি মাস মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রতিফলনের উপহার স্বরূপ ঈদউল ফিতর এক অপূর্ব উৎসব। এই উৎসবসমূহ ধনীদরিদ্র, রাজাপ্রজা, শোষকশোষিত প্রত্যেকের জন্যই অনাবিল সম্প্রীতিসৌহার্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মানবিকতার মহাত্মকে অত্যুজ্জ্বল করে। সকল শ্রেণি পেশা নির্বিশেষে প্রত্যেকেই যার যার সামর্থ অনুযায়ী নতুন পোষাকপরিচ্ছদ, খাবারদাবার এবং নামাজ শেষে প্রীতিবিনিময়ের অনুষঙ্গে ঈদ হয়ে উঠে সর্বজনীন। আবার এই ঈদকে ঘিরেই সারাটা বছর বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত ব্যবসায়ীবৃন্দ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরণের আকর্ষণীয় কাপড়চোপড় ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি বিক্রির মহাউৎসবে মেতে ওঠে। পুরো বছরের সকল আয়োজন সম্পন্ন হয় রোজার মাস ও ঈদ উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে।

একই ধারায় ঈদউল আযহা বা মহান আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ্‌ করে সবাইকে নিয়ে আনন্দ সহকারে ভোজনবিতরণ উৎসব অত্যন্ত উপভোগ্য। এই ঈদউল আযহাকে কেন্দ্র করে আমাদের কৃষি সমাজে গবাদি পশুর লালনপালন এবং গ্রামঅর্থনীতির চাকাকে সচল করার অনবদ্য এক পন্থা হিসেবে প্রচলিত। পবিত্র ইসলাম ধর্মে সাম্য ও ধনীদরিদ্রের ব্যবচ্ছেদ নিধনকল্পে যাকাত প্রদানসহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞে অসাধারণ বৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার সর্বত্রই সমাদৃত। মূলত ইসলাম শব্দটি ‘আসলামা’ থেকে উদ্ভূত যার নির্যাস হলো শান্তি এবং ‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ হলো আত্মসমর্পণকারী। এই সর্বোচ্চ মহানুভব মর্ত্যজয়ী ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা (সঃ) এর ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে। আমাদের হয়তো অনেকেরই জানা যে, শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০৬০০০ বছরের সময়সীমাকে আদি পিতা হযরত আদম, ২০০০১০৫৬ হযরত নূহ, ২০০০১৭০০ হযরত ইব্রাহীম, ১৩০০ হযরত মূসা, ১০০০ হযরত দাউদ, ৯০০ হযরত সোলায়মান, ৩০ খ্রিষ্টাব্দ হযরত ঈসা এবং ৫৭০৬৩২ হযরত মুহাম্মদ (🙂 এর কালের আবর্তে মানব জাতির ধর্মীয় ক্রমান্বয়কে বিবেচনা করা হয়।

ধর্ম’ শব্দটি ‘ধৃ’ ধাতু থেকে নেয়া হলেও এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ধারণ করা। নিজের ও অপরের জীবন সমৃদ্ধিতে নিবেদিত সকল কর্মেরই যোগফল হচ্ছে ধর্ম। আধুনিক দার্শনিকদের মতে ধর্মের সংজ্ঞা অনেকটা জটিল ও ব্যাখ্যা সম্বলিত। ‘হযরত নূহের প্লাবনের পর কা’বা শরীফ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) হযরত মুহাম্মদ (🙂 এর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এসময়েই তিনি আল্লাহ নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং দুইপুত্রসহ (ইসমাইল ও ইসহাক) উভয়কেই ‘মুসলিম’ (আত্মনিবেদিত) বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা বাণী থেকেই ইব্রাহীমের বংশধরগণ মুসলিম বা মুসলমান হিসেবে পরিচিত হন’। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মহান আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণকারীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং তাঁর পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষেই নিজের সর্বোত্তম প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ) এর জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। সেই থেকে মানুষের জীবনের পরিবর্তে পশুর প্রাণ নিবেদনের মাধ্যমেই পবিত্র কোরবানির প্রচলন শুরু হয়। ঈদউল আযহা খ্যাত এই ঈদ জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে নামাজ আদায় শেষে পশু জবেহ্‌ করে ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোরবানি ঈদ উদ্‌যাপন করা হয়।

ইসলামের মূল রোকন রোজার পরেই হজ্বের অবস্থান। এই জিলহজ্ব মাসেই নির্দ্দিষ্ট দিন সমূহে পবিত্র কা’বা শরীফ ও তার নিকটবর্তী আরাফাতমিনামুজদালিফাসহ কয়েকটি পবিত্রতম স্থানে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসুল (সঃ) এর নির্দেশ মোতাবেক অবস্থান ও কার্যাদি নিবিড় একাত্মতার সাথে এবং কায়মনোবাক্যে সকল পাপ মুক্তির প্রার্থনা জানিয়ে হজ্বব্রত পালন করেন। সুস্থ ও ভ্রমণে সক্ষম ব্যক্তি সম্পূর্ণ বৈধ বা হালাল উপার্জনে প্রয়োজনীয় খরচ বহন করার ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের হজ্বব্রত পালন করা ইসলাম ধর্মে ফরজ বা বাধ্যতামূলক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারিত। বৈধ ও অবৈধ উপার্জনের যথার্থ বিভাজন নির্ণয় ব্যতিরেকে অনৈতিক ও ইসলামে অনুমোদনহীন পন্থায় অর্জিত অর্থে প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যয় এবং কার্যক্রম কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমাদের প্রিয় নবী রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘অতিশীঘ্রই একটি সময় এরকম আসছে, যখন মানুষ এর কোনও পরোয়া করবে না যে, সম্পদ বৈধ কিংবা অবৈধ।’ [বুখারী : ২০৫৯, আবু হুরাইরা (রা:)] অতএব এই সম্পর্কে যথার্থ সজাগ থাকা এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

সমাজ বা লোক দেখানোর জন্য বা নামের পূর্বে ‘আলহাজ্ব’ বিশেষণ যুক্ত করার লক্ষ্যে নিজের বা অপরের অবৈধহারামঅপাংক্তেয় অর্থ খরচে হজ্ব পালন অবশ্যই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। হজ্বব্রত পালনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে কোরবানি। পবিত্র ঈদউল ফিতর নামাজের পূর্বেই আর্থিকভাবে সামর্থবান ব্যক্তিদের ফিতরা আদায় করা যেমন ওয়াজিব, তেমনই সাদকাতুল ফিতরার মতো কোরবানিও ওয়াজিব। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, উট, মহিষ ইত্যাদির দোষত্রুটিহীন বা চোখকানাঅন্ধখোঁড়াকানকাটালেজকাটাশিংভাঙ্গাঅত্যন্ত দুর্বলদাঁতহীন দোষযুক্ত পশুদ্বারা কোরবানি পরিত্যাজ্য। কোরবানির মাংসসহ ভোজনযোগ্য গবাদিপশুর হালাল সকল কিছুর তিনভাগের একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয়স্বজনদের জন্য, এবং আরেকভাগ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করার কঠোর বিধান রয়েছে। মুসলমানদেরকে কুরবানীর মাংস খাওয়া এবং অন্যকে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে আদেশ দিয়ে বলেন, ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থঅভাবগ্রস্তকে আহার করাও’ (আল কুরআন২২:২৮)। নবীজী (সাঃ)ও কুরবানির মাংস খেতে উৎসাহ দিতেন। হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘কিছু খাও, কিছু সঞ্চয় কর এবং কিছু গরীবদের মাঝে বন্টন করে দাও’ (নাসাঈ)। কুরবানীর মূল নির্যাস হচ্ছে; অর্থ বিত্তের বিনিময়ে নিছক পশু জবেহ নয়, অন্তরের প্রগাঢ় অন্ধকার ও হিংস্র পশুত্বের নির্মূল করা না গেলে উপযাচিত এসব কর্ম কখনোই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থিত হবে না।

পবিত্র ইসলাম ধর্মে শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে; প্রতিক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ন্যায়নীতির মানদন্ডে জীবন প্রবাহের সকল কার্যক্রমের প্রতিপালন। অন্যথায় সততান্যায়পরায়ণতামানবিকতানৈতিকতা বিবর্জিত কর্তব্য পালনে বিচ্যুতি ইহকাল ও পরকালকে নি:সন্দেহে কলুষিত করবেই। ন্যূনতম ধর্মে বিশ্বাসী কোন মানবের পক্ষে গর্হিত কর্মের সাথে সম্পর্কিত হওয়া মহান স্রষ্টার দৃষ্টিতে ক্ষমাহীন অপরাধ। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের কৃতকর্মগুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, “হে মানুষ সকল ! তোমাদের অবাধ্যতা ও বিদ্রোহীতার কুফল তোমাদের উপরই পতিত হবে, দুনিয়ার জীবনের মালদৌলত কিছুদিন উপভোগ করে নাও অত:পর আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে, তখন আমি ঐ সকল কাজের বাস্তবতা সম্পর্কে তোমাদের জানিয়ে দিব যা তোমরা করতে।” [সূরায়ে ইউনুস ঃ ২৩]

সকল ধরনের কুকর্মকুবৃত্তিকুপ্রবৃত্তিদুর্বৃত্তায়ননিরিহ ও অসহায় মানুষকে ঠকানো থেকে পরিপূর্ণ নিজেকে বিরত রেখে ধার্মিকতার মাধুর্য ও সৌন্দর্যের প্রতিপালনই মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির অপরূপ পন্থা। চরিত্রহীনতাঅন্যের সম্পদ লুন্ঠনঅবৈধ অর্থলিপ্সু সম্পদ উপার্জন ব্যয়ের মাধ্যমে মসজিদ নির্মাণ, বারং বার হজ্ব সম্পাদন, বিশাল অঙ্কের বহুসংখ্যক গবাদিপশু জবেহ করে ক্ষমতা বা আধিপত্য প্রচারপ্রসার ও পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত সকল কর্মই পবিত্র ইসলাম ধর্মে প্রচন্ড পাপাচার। কোরবানির পশু জবেহ করে লোক দেখানো ধর্মকর্মের আড়ম্বতা ধর্মসভ্য সমাজ স্বীকৃত নয়। বিশ্বাস ও আস্থাহীনতাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্যই অত্যন্ত পবিত্র প্রিয় রসূলের সুন্নতের অমর্যাদা করে শুধুমাত্র অসৌজন্য লৌকিকতায় দাঁড়ি, টুপি, নামাজ আদায়ে কপালে কালো দাগ; পবিত্র ইসলামকে নয় বরং ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের অধর্মকেই জ্ঞাপিত করে। প্রত্যেক ধার্মিক মুসলমানের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত যে; বিশ্বাস ও কর্মের পিছনে রয়েছে যৌক্তিকপ্রজ্ঞাঅসাম্প্রদায়িকতা তথা সামগ্রিক মানবধর্মের সৌহার্দসম্প্রীতিবন্ধুত্ব ও প্রীতির নিগূঢ় বন্ধন। ঈদ উল আযহার এই মহান দিনে দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানাই অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকাশ্যে শাকিবের ‘ও প্রিয়তমা’