গাড়ীটা বালুচরা ক্যান্টনমেন্ট এর মুখে আসতেই ছেলেটাকে চোখে পড়লো।আট দশ বছরের একটা ছেলে। মুখটা ভারী মায়াবী। গায়ের রংটা কালো।রোদে পুড়ে তামাটে রং ধারণ করেছে। কাধেঁ হরেক সাইজের বাংলাদেশের পতাকা। সবুজের মাঝে টকটকে লালে রাঙা পতাকা।যে গাড়ীটা থামছে ক্যান্টনমেন্টের মুখে— তার কাছে দৌঁড়ে যাচ্ছে আর বলছে— পতাকা নেবে, পতাকা।
গাড়ী থামাতেই কাছে আসলো সে।
জিঙেস করলাম – নাম কি তোমার?
সাকিব আল হাসান।
বাহ আমাদের বেষ্ট ক্রিকেটার এর নামে নাম।
মুখ ভর্তি হাসি সাকিবের।
পতাকা কেন বিক্রি করছো?
ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস।তাই পতাকা বিক্রি করছি।
বাহঃ চমৎকার বললে।তুমি কি স্কুলে যাও?আই মিন পড়াশোনা করো।
জ্বী করি।তবে স্কুলে যাই মাঝেমধ্যে।
কেন মাঝেমধ্যে কেন?
কারণ মাকে সাহায্য করতে হয়।মা একা পারেনা সংসার এর খরচ চালাইতে।
ততক্ষণে আমি গাড়ী থেকে নেমে ক্যান্টনমেন্ট এর ভিতরের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম সাকিবকে নিয়ে।
আচ্ছা সাকিব পতাকা বিক্রি করছো –মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা এসব বুঝ।
হ অনেক বুঝি। পাকিস্তানি রা আমাগো দেশটাকে তাগো করতে চাইছিল। চাইছিলো আমরা তাদের গোলাম হইয়া পড়ে থাকি।
ছেলেটার কথাগুলো শুনে চোখ ভিজে উঠলো।গায়ের লোম গেলো খাড়া হয়ে।
হতদরিদ্র এক কিশোর পতাকা ওয়ালার কথায় প্রাণ খুঁজে পেলাম।
দিনে কয়টা পতাকা বিক্রি হয়?
বিশ ত্রিশ টার মতো।
এ বিক্রি তে পোষায়।
হ পোষায় আবার পোষায় না।তবে এ কাজটা করে সুখ পাই মনে আনন্দ পাই।আমার থেকে পতাকা নিয়ে যখন গাড়ীতে লাগায়।আর তা পতপত করে উড়ে তখন অন্যরকম আনন্দ লাগে।হাতে নেয় যখন কোন ছোট্র পোলাপান বা তাঁর বাবা– মনে হয় এই বুঝি যুদ্ধ শেষে নতুন পতাকা হাতে উঁচিয়ে ফিরলো কোন যোদ্ধা।
বলার সময় সাকিবের চোখেমুখে যে আলোর দেখা পেলাম তা ভুলবার নয়।
এই পতাকা আমার পতাকা।আমার মায়ের পতাকা।এটারে পাইতে আমাগো কম কষ্ট করতে হয়নি।তাই ডিসেম্বর মাস আসলেই মা বলে— যা বাজান পতাকা বেচে আয়। এ মাসেই এ পতাকাটা আমরা পাইছি বাপ।তোমার নানায় এ পতাকা আনতে গিয়া আর ফেরত আসেনি। তাই তুমি পতাকা বেচবা।
আমার মারও কষ্ট লুকানো আছে ডিসেম্বর কে ঘিরে। তাই আমি পথে পথে পতাকা নিয়ে ঘুরি।পতাকা নেবেন, পতাকা।
সেদিনের মতো সাকিবের সব পতাকা আমি কিনে নিই। কী যে খুশী হলো ছেলেটা। দেখেই মন ভরে গেলো।
এরপর যতোবারই ঐ রাস্তা দিয়ে— যাই– সাকিবকে খুঁজি। একটুকরো বাংলাদেশ হাতে আর বুকে নিয়ে সাকিব দৌড়াতে থাকে,– পতাকা নেবেন,পতাকা।