নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং কিছু স্মৃতি

মো আসহাব উদ্দিন | সোমবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকালীন, দীর্ঘ নয়মাসের বিভিন্ন অপারেশনের মধ্যে, সবচেয়ে ট্র্যাজিক ও নির্মম যে সময় অতিবাহিত হয় তা হলো, আমি কিভাবে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে আসলাম। সেদিন শাহজাহান ইসলামাবাদীসহ গ্রুপের আমরা কয়েকজন রাত প্রায় ৮/.৩০ টার দিকে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। খাওয়াকালীন খবর পেলাম, পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সহায়তায় আমাদের বরকলস্থ শেল্টারের দিকে আসছে এবং গুচিয়া গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছে। তখন শেল্টারে আমরা ৫/৬ জন ছিলাম এবং অস্ত্রের মধ্যে আমাদের কাছে একটি এস এম জি, একটি এস এল আর এবং কিছু গুলি ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে শুনে, আমরা সবাই সেই অবস্থায় খাওয়া বন্ধ করে কী করা যায় পরামর্শ করি। সার্জেন্ট আলম বললেন, আমাদের নিকট থাকা অল্প অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ না করে তৈলারদ্বীপ শেল্টারে যাওয়া ঠিক হবে। এতে আমরা একমত হয়ে, তৈলারদ্বীপ লতিফের শেল্টারের দিকে যাত্রা করি। পরের দিন জানতে পারি, শুচিয়া গ্রামে, আমাদের আরেকটি শেল্টারে থাকা আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করায় পাকিস্তানিরা ঐ রাতে ফেরত যায়। ঐ দিন আমরা রাত প্রায় ১২/১ টার দিকে লতিফের শেল্টারে পৌঁছি এবং খাওয়া দাওয়া সেরে ঐখানে লতিফের বাড়ির শেল্টার সংলগ্ন গোয়াল ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, ভোর ৪/৫ টার দিকে আমরা বরকল শেল্টারের দিকে রওয়ানা হয়ে বরকল ফেরিঘাট বাজারে আসি। সেখানে একটি চায়ের দোকানে নাস্তা করার পর শাহজাহান ইসলামাবাদী বললেন, সার্জেন্ট আলম ও মরিদুল আলমসহ তারা বাঁশখালী একটি শালিসি বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য যাবেন। তখন প্রায় ভোর হয়ে যায়। তিনি আমাকে বলেন, তুমি চট্টগ্রাম শহরে যাও। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা সার্কিট হাউসে টর্চার সেল তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের অমানবিক অত্যাচার করছে। শহরের অনেক লোক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তোমার পরিচয় আছে। শহরের গেরিলা কমান্ডার সৈয়দ আহমদ প্রকাশ বেটে সৈয়দের সাথে সাক্ষাৎ করে, সার্কিট হাউস অপারেশনের ব্যাপারে কোনও সহায়তা করতে পার কিনা চেষ্টা কর। এই বলে, আমরা চায়ের দোকান থেকে উঠে হেঁটে খালের (নদীর) ঘাটের দিকে আসি। আমি নৌকায় ঘাট পার হয়ে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং শাহজাহান ইসলামাবাদী ও উনার সঙ্গীরা খালের পাড় দিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকেন। ঐ সময় উনাদের সাথে একটি এস এম জি ও একটি এস এল আর ছিল।

চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে, আমি খবর নিয়ে জানতে পারি, রহমতগঞ্জ সি এন্ড বি অফিসে একজন এয়ার কন্ডিশন ইঞ্জিনিয়ার আছেন। যার কাছে, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে যে কোন সময় প্রবেশের জন্য এস জেড এম এলের (ঝতগখঅ) পাস রয়েছে। তার সঠিক নাম মনে পড়ছে না তবে, সিরাজুল ইসলাম হতে পারে এবং তার বাড়ি ঢাকা জেলায়।

আমি রহমতগঞ্জ সিএন্ডবি অফিসে গিয়ে, তার সাথে সাক্ষাৎ করি। তাকে বিষয়টি বলতেই তিনি সাহায্যের জন্য রাজি হয়ে যান। এই ব্যাপারে আমার আরেক বড় বোনের স্বামী আহমদ সবুর সাহেব যিনি সিএন্ডবি অফিসে ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তিনি আমাকে সহায়তা করেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে আলোচনা করে, বিকাল প্রায় ২.৩০/.০০ টার দিকে আমি আর উনি শহরের খাতুনগঞ্জসহ লামার বাজার চাক্তাই খাল সংলগ্ন সৈয়দ আহমদের শেল্টারে যাই এবং তাদের সাথে বসে অপারেশনের পরিকল্পনা করি। আমার যতদূর মনে পরে, সেই সময়টা রমজান মাসের শুরুর দিকে হবে। সিদ্ধান্ত হয়, ইফতারের পর আমরা লামারবাজার শেল্টারে আসবো এবং পরিকল্পনামতো কাজ করবো। আমরা যথাসময়ে ইফতার ও মাগরিবের পর এসে দেখি ঐ রাস্তায় কারেন্ট নেই এবং গলিটি অন্ধকার। আমরা খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেটের দিক থেকে গলিতে ঢুকে চাক্তাই খালের ব্রিজে উঠতেই ‘হ্যান্ডস আপ’ করে ডাক দেওয়ার চিৎকার শুনি এবং দেখি কালো পোশাক পরিহিত অনেক পাকিস্তানি সৈন্য অস্ত্র উচিয়ে আমাদের ও ঐ পুরো এলাকা ঘেরাও করে ফেলে। একজন আর্মি অফিসার হাতে এস এল আর দিয়ে, শালা বাঙালি কুত্তা বলে গালি দিয়ে, আমার ডান পাশের বুকে, এস এল আরের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে। পরে জানি উক্ত পাকিস্তানি অফিসার কাশ্মীর রেজিমেন্টের একজন মেজর। উল্লেখ্য, অন্ধকার গলিতে ঢুকার সময় আমি একটা সিগনাল পাই, কিন্তু আমি ভাবলাম আমাদের লোক তাই আমিও আমার সিগনাল জানাই। কিন্তু পরে বুঝলাম, এখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা রেইড করেছে এবং পুরো এলাকা সৈন্য দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে। আমরা, ধরা পরে গেলাম তাদের হাতে। তারা আমাকে এবং আমার সঙ্গী ইঞ্জিনিয়ারকে ধরে নিয়ে, কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে, যেখানে নিয়ে গেল সেখানে শুধু আমরা নই এরকম আরো অনেক দেশপ্রেমিক ছিল যাদের অন্যায়ভাবে অমানসিক শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধোদের তথ্য নেয়া হত, তাদের নির্যাতনে কেউ মরে যেত বা মেরে ফেলা হত। এভাবে ১০/১২ দিন টর্চার সেলে রাখা হয়েছে আমাদের। পরে শুনলাম, আমাদের নিয়ে তাদের মধ্যে দুভাগ হয়ে গেছে। একপক্ষ চাচ্ছে, আমাদের মেরে ফেলতে আরেক পক্ষ চাচ্ছে ছেঁড়ে দিতে। এভাবেই কাটতে লাগলো সময়, টর্চার সেলে তারা কিভাবে নির্যাতন করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন ।

আমাদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সিনেমা প্যালেসের নিকট হোটেল ডালিমের চারতলার পূর্বপাশে একটি অন্ধকার কক্ষে। কয়েক দিন পর আমাকে চোখ বেঁধে আর্মি পিক আপের পেছনে বসিয়ে আগ্রাবাদ হয়ে পতেঙ্গার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ভাবলাম, হয়তো মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু আগ্রাবাদ বারেক বিল্ডিং হয়ে পোর্টের দিকে যাওয়ার পথে আমার চোখ খুলে দিয়ে, পিক আপ থেকে নামিয়ে আমাকে বললো, আপনি চলে যান । আমি হতভম্ব হয়ে, রাস্তার উত্তর পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করি এবং পরে আমার বড়ভাইয়ের ঘাটফরহাদবেগস্থ বাসায় আসি। তারা অবাক হয়ে, আমি কোথায় থেকে আসলাম জিজ্ঞেস করলো, তারা কেউই জানতো না আমি এতদিন কোথায় ছিলাম। পরদিন সকালে আমি বরকলস্থ আমাদের শেল্টারে ফিরে এসে আমাদের গ্রুপের সাথে যোগ দিই। পরে জানলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রায় নয়মাস, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য আমরা ত্যাগ স্বীকার করি। যার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি ও শাহজাহান ইসলামাবাদী ৩১শে জানুয়ারী, ১৯৭২ইং পটিয়া থানায় অস্ত্র জমা দিই। জমা দেওয়া অস্ত্রের মধ্যে ছিল, তিনটি ৩০৩ রাইফেল, একটি এস এল আর, /৮ টি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং একবক্স রাইফেলের গুলি । তৎপূর্বে আমাদের অন্যান্য সাথী যোদ্ধারা আমাদের দুজনকে বাদ দিয়ে তাদের অস্ত্র জমা দিয়েছে ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্ত্র জমা দিয়ে, লেখাপড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে? বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে উন্নীত করছে, যা দেখে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করছে যা খুবই প্রশংশনীয়। মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক সম্মানী ভাতা পাচ্ছে এবং মৃত্যুর পর তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হচ্ছে। তাদের স্মৃতিরক্ষার্থে দেশের বিভিন্ন সড়কের নাম, তাদের নামে নামকরণ করা হচ্ছে, যা খুবই ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তথা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে বলেই, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে, যা পূর্বের কোনও সরকার করেনি। বরং জামায়াত, শিবিরের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চেয়েছিল। এর মধ্যেও একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তোলে, তা হলো, দুর্নীতি। আমরা চাই, বাংলাদেশ হোক দুর্নীতিমুক্ত। কারণ দুর্নীতি জাতীয় জীবনের সকল উন্নতির অন্তরায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হোক দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, এই আমার প্রত্যাশা। জয় বাংলাজয় বঙ্গবন্ধুবাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের মানস গঠন ও সংস্কৃতি চর্চা
পরবর্তী নিবন্ধহার্ট অ্যাটাকের ঋতু শীতকাল : সতর্কতা জরুরি