হার্ট অ্যাটাকের ঋতু শীতকাল : সতর্কতা জরুরি

অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ | সোমবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শীতঋতু বিষয়ক উপলব্ধি এ রকম– ‘শীতটা বৈশ্য। তাহার কাটা ধান, কাটাই মাড়াইয়ের আয়োজনে চারিটি প্রহর ব্যস্ত। কলাই, যব,ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরনীর ডালা পরিপূর্ণ। প্রাঙ্গণে গোলা ভরিয়া উঠিয়াছে। গোষ্ঠে গরুর পাল রোমন্থন করিতেছে, ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল, পথে পথে ভারে মন্থর হইয়া গাড়ী চলিতেছে; আর ঘরে ঘরে নবান্ন এবং পিঠাপার্বনের উদমবেগে ঢেঁকি শালা মুখরিত।’ আর স্কটিশ কবি রবার্ট ব্লেয়ারের মতে, ‘ বিয়ের জন্য উপযুক্ত ঋতু হচ্ছে শীত। তা বিবাহিত দম্পতিদের কাছে খুবই কাম্য এবং আকাঙ্ক্ষিত ঋতু।’ অর্থাৎ শীতকাল বিভিন্নভাবে প্রাচুর্যের কাল। তা মিলনের উপযুক্ত সময়। কিন্তু, এই ঋতুতে শীতের দাপট ক্ষেত্র বিশেষে বিরহেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গত ৮ জানুয়ারী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, পাশের দেশ ভারতে প্রচন্ড শীতে একদিনে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে গত ৫ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে একদিনে প্রবল ঠান্ডায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এখানকার চিকিৎসকরা জানান ঠান্ডায় হঠাৎ করে রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ফলে ঘটে যাওয়া হার্ট অ্যাটাকই এই মৃত্যুর কারণ। অন্যদিকে আমেরিকার এক গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখানে শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের প্রকোপ অন্য সময়ের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগ বেড়ে যায়। তা হৃদরোগী ছাড়াও আপাত সুস্থদের ক্ষেত্রেও ঘটে এ সময়ে। তাই এখানে শীতকালকে বলা হয় ‘হার্ট অ্যাটাকের কাল’। তবে আমাদের দেশ শীত প্রধান নয়। কাজেই এখানে শীতকাল এই অভিধায় ভূষিত হয়নি। এখানে শীতে নিউমোনিয়া ও শ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তবে এখানেও শীতে হৃদরোগ তথা হার্ট অ্যাটাকের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে সম্পাদিত “ঋতু বৈচিত্র ও হৃদরোগের প্রকোপ” শীর্ষক এক গবেষণায় শীত ঋতুতে হৃদরোগের প্রকোপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এই গবেষণায় দেখা যায়। এই বিভাগে সবচেয়ে বেশী রোগী ভর্তি হয়েছে শীতকালে এবং সবচেয়ে কমরোগী ভর্তি হয় গ্রীষ্মকালে। দেখা গেছে এখানে হার্ট অ্যাটাক জনিত মোট মৃত্যুর সংখ্যাও শীতকালে বেশী ছিল। তারও আগে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের এক সমীক্ষায় একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল।

আমাদের দেশে চলতি শীতে ইতিহাসের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বিভিন্নস্থানে। প্রচণ্ডশীতে জনসাধারনের বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও ছিন্নমূল মানুষের দুর্বিষহ কষ্টের সাথে হৃদরোগের ভোগান্তি ও মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের হৃদরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে আগত ও সিসিইউতে ভর্তি রোগীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষেত্রে এই শীতের প্রভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে।

শীতে হার্ট অ্যাটাকের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্তনিহিত কারণগুলো শরীরবৃত্তীয়। এতে ক্রিয়াশীল বিষয়াদি নিম্নরূপ :

ম শীতে শরীরের সব রক্তনালী সংকুচিত হয়ে পড়ে। হৎপিণ্ড রক্তনালীর মারফত সমস্ত শরীরে রক্ত পাঠায়। রক্তনালী সংকোচনে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এতে উচ্চ রক্তচাপগ্রস্তদের রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড শীতে রক্তচাপ বেড়ে বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধিতে হার্টের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। এতে দেখা দিতে পারে হার্ট অ্যাটাক। বিশেষত যাদের হৃৎপিণ্ডের করোনারীতে আগে থেকে কিছু ব্লক রয়েছে তাদের। হার্ট অ্যাটাকের পাশাপাশি তা মস্তিস্কে স্ট্রোকেরও কারণ হতে পারে।

ম শীতে এনজিনা বা বুকব্যথা দেখা দিতে পারে। তা হৃৎপিণ্ডের করোনারী রক্তনালীকে সংকুচিত করার কারণে ঘটে। এতে বুক ব্যথা ও হৃদরোগের অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে শীতার্ত ব্যক্তি হঠাৎ উষ্ণ পরিবেশে পৌঁছালে কিংবা উষ্ণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে হঠাৎ শীতের পরিবেশে পৌঁছালে করোনারী রক্তনালীর প্রতিবন্ধকতায় রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

ম শীতে হৃৎপিণ্ডের কাজ বেড়ে যায়। শীতে শরীরের রক্তপ্রবাহ নির্বিঘ্ন রাখতে ও শরীরের স্বাস্থ্য সম্মত তাপমাত্রা বজায় রাখতে হৃৎপিণ্ডকে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এতে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায় এবং তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

ম শীতে তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পেলে হৃৎপেশী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রির নিচে নেমে আসলে হৃৎপেশী তার কর্মক্ষমতা হারায়।

ম জীবন যাত্রার পরিবর্তন তীব্র শীতে মানুষ অলস ও আরামপ্রিয় হয়ে পড়ে। এতদিনের ব্যায়ামের অভ্যাসে সহসা ছেদ পড়ে কখনও কখনও। ব্যায়ামের সময় কিংবা শারীরিক কর্মসাধনের সময় হৃৎপিণ্ডসহ শরীরের অন্যান্য রক্তনালী প্রসারিত হয়ে শরীরে বাড়তি রক্ত সরবরাহ করে যা ঐ পরিস্থিতিতে শরীরের চাহিদা মেটাতে আবশ্যক। কিন্ত শীতে এসব রক্তনালী সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়। এ পরিস্থিতিতে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালী কোলেস্টেরল জমা হয়ে আগে থেকে আংশিক অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে তার উপর ঘটে যাওয়া শীতজনিত সংকোচন রক্ত চলাচলকে আরো কমিয়ে ফেলে। এতে দেখা দেয় এনজিনা আর হার্ট অ্যাটাক।

ম খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন কম শারীরিক কসরতের পাশাপাশি বেশি খাবার গ্রহণে রক্তের গ্লুকোজ ও কোলেস্টেরল বৃদ্ধিসহ মেদ বাহুল্য দেখা দিতে পারে। শীতে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। খাবারের চাহিদাও বাড়ে। মিলনের ঋতু শীত মৌসুমে বিভিন্ন সামাজিক আনুষ্ঠানে গৃহীত চর্বি ও উচ্চ ক্যালরীযুক্ত খাবার শরীরের উপর বিরূপ প্রভার ফেলে। শরীরে উঞ্চতা পেতে কেউ কেউ অতিমাত্রায় কপি ও চা পান করে। এতে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। সাময়িক শারীরিক উত্তাপ পেতে কেউ কেউ এলকোহলও গ্রহণ করে। আবার ধূমপায়ীরা অধিক মাত্রায় ধূমপান করে। এই সবই হৃদপিণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।

ম অন্যান্যতীব্রশীতে বরফ সরানো ও তুষারাচ্ছন্ন পরিবেশে কষ্টসাধ্য কাজ করতে গিয়ে রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হার্ট অ্যাটাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ ধরনের বরফ সরানোর কাজ পশ্চিমা বিশ্বে শীতের দিনে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তা অবশ্য আমাদের দেশে এখনও ঘটেনি।

এক্ষেত্রে করণীয় :-শীতের দাপট থেকে রক্ষায় আবশ্যকীয় উপদান শীতবস্ত্র। উপযুক্ত শীতবস্ত্র পরিধান করুন। এছাড়া বাড়তি কিছু সতর্কতা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে কার্যকর

ম হৃৎবান্ধব খাবার গ্রহণ করুন। চর্বিযুক্ত ও উচ্চ ক্যালরীযুক্ত খাবার সীমিত করুন।

ম উত্তেজক পানীয়, যেমন ঘন ঘন চা ও কপি পান থেকে বিরত থাকুন বিশেষত আপনি হৃদরোগী হলে।

ম অ্যালকোহল বর্জন করুন, তা সাময়িক উষ্ণতা আনে বটে তবে পরবর্তী সময়ে ঠান্ডায় গেলে তা বিপদজনক হয়ে দেখা দেয়।

ম নিয়মিত ব্যায়াম চালিয়ে যান। শীতের অজুহাতে ব্যায়াম বন্ধ করবেন না।

ম মানসিক চাপ পরিহার করুন, মেডিটেশন করুন।

ম ঘনঘন হাত পরিস্কার করুন। এতে শ্বাসনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। এ ধরনের সংক্রমন হার্ট অ্যাটাক তরান্বিত করে।

ম লম্বা সময় ধরে প্রচণ্ড শীতে অবস্থান করবেন না।

ম নিয়মিত চেক আপ করুন। আপনার রক্তচাপ, রক্তের কোলেষ্টেরল, গ্লুকোজ পরীক্ষা করে দেখুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। হৃদরোগের কোন উপসর্গ যেমন বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিলে বিলম্ব না করে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

পরিশেষে বলা যায়, শীত আর হৃদরোগের সহাবস্থান সুখকর নয়। আপনি হৃদরোগী হলে কিংবা আপনার মধ্যে হৃদরোগের বুঁকিপূর্ণ কোন উপাদান থাকলে এ সময়ে সতর্কতা অবলম্বন করুন। সুস্থ থাকুন।

লেখক : মহাসচিব, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন; সাবেক বিভাগীয়

প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং কিছু স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধবুর্জ খলিফায় শাহরুখের ‘পাঠান’ সিনেমার ট্রেলার