শিক্ষার্থীদের মানস গঠন ও সংস্কৃতি চর্চা

বাসুদেব খাস্তগীর | সোমবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবেদন চিরকালীন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। সেই প্রতিভা কেউ কেউ বিকশিত করার সুযোগ পান আবার কেউ কেউ নানা প্রতিবন্ধকতায় তার প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পান না। সে প্রসঙ্গটা ভিন্ন এক বিষয়। কিন্তু এ প্রজন্মের অনেকের কাছে বদ্ধমূল এক ধারণার জন্ম দিয়েছে যে শিল্পসাহিত্য চর্চার বিষয়গুলো নিতান্তই গৌণ এবং এগুলো থেকে একটু দূরে থাকাই শ্রেয়। এ ধারণা কোনো অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয়; বরং অনেক উচ্চ শিক্ষিত এলিট শ্রেণির মধ্যে এ ধারণা বিদ্যমান। তাদের মাধ্যমেই ধারণা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র, নাটক, শিল্পকলা, গান, নৃত্যের মত সৃজনশীল একজন মানুষের মানস গঠনের উপাদানগুলো ক্রমেই গৌণ সমাজে হয়ে যাচ্ছে। এ এক নিদারুণ কষ্টের ব্যাপার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইদানীং কালের এই চালচিত্র বড়ই নাজুক। বিগত দশ বিশ বছর আগেও আমাদের চিন্তা ভাবনা আরো অনেক অগ্রসরমান ছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী বা আগের সময়ের কথা বাদই দিলাম। সামনে এগিয়ে চলার সময়ে শুধু এক শ্রেণির মানুষের পিছুটান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানস গঠনের উপাদান থেকে কৌশলে দূরে দেয়ার অপচেষ্টাতে কোনো অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নয় বরং অনেক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অপচেষ্টা সত্যিই বিস্ময়কর। শাহ আবদুল করিমের ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয় ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। গত ২৫ অক্টোবর ২০২২ তারিখে দৈনিক আজাদীর সম্পাদকীয় কলামে ‘দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় সচেতন হতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশপ্রেমে’ শীর্ষক সম্পাদকীয় লেখায় বলা হয়েছে, ‘আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে দেশের মানুষের আচরণে প্রভাব পড়ছে।

এ ছাড়াও কর্ম ব্যস্ততা, সাংসারিক টানাপোড়েন, সামাজিক সংকীর্ণতা, মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার অভাব প্রভৃতির কারণে দেশের মানুষ শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় বিমুখ হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে। এটাকে বাংলার সংস্কৃতির বড় ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞরা।’ এই কথাটা সত্যি, কিন্তু ব্যস্ততা, টানাপোড়েন ইত্যাদির বাইরেও সামাজিক সংকীর্ণতা ও মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার অভাবের যে কথা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সামাজিক সংকীর্ণতা ও মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার যে ভাটা তার গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। এক ধরনের মানুষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে যারা চিন্তা চেতনায় সংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানের জানান এবং অন্যকে উৎসাহ জোগান। সেজন্য যে কোনো জায়গায় আজকাল এসব কার্যে জড়িত হলে প্রচ্ছন্নভাবে একটি শক্তি বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় অথবা পরোক্ষভাবে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। অনেকেই প্রকাশ্যে কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে নেতিবাচক কাজ করেন। তাদের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ছেই। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মানস গঠন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে তারা এক ধরনের দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। হয়তো এমন এক সময় আসবে একটি প্রজন্ম শেষে সংগীত, নৃত্য করার কিংবা শিল্পকলা চর্চার ছেলেমেয়ে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। সত্যিকারভাবে বলা যায় বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাচগানআবৃত্তিছবি আঁকা শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। অধিকাংশ অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের নাচগাননাটকথিয়েটার কিংবা সুকুমার বৃত্তিগুলোর চর্চায় আগ্রহী নন। কারণটা ভিন্ন জায়গায়। এ কারণে সামাজিক সংকীর্ণতা ও উৎসাহ উদ্দীপনার ব্যাপারটা শক্তিশালী হয়ে উঠছে ক্রমাগত। পারিবারিকভাবে এই আবহ বা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রজন্মের অনেকেরই এই বিষয়ে চরম দৈন্য মনোভাব দেখা যায়। তাদের নিরুৎসাহিত ভাব অন্যদেরকে প্রভাবিত করে। ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চায় এক ধরনের মেরুকরণ চলছে। যেটুকু হচ্ছে তা নিতান্তই সরকারের বাধ্যবাধ্যকতায়; এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর তত স্বতঃফূর্ততায় নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃতি বিকাশের জন্য কোনো সুখকর খবর হতে পারে না। বেশ কয়েকবছর আগেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিল্পসাহিত্য চর্চা ও প্রতিযোগিতার কথা বললে অনেকেই এগিয়ে আসতো এবং অনেক নাচ গান জানা কিংবা কবিতা লেখা বা বিতর্ক করা ছাত্রছাত্রীদের দেখা মিলতো। এখন এসব ক্ষেত্রে চরম সংকট। শুধু নতুন শিক্ষার্থী নয়নতুন অনেক শিক্ষকদের মধ্যেও এ সংকট প্রবল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন আসা অনেক শিক্ষকের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আগ্রহ বা উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। সংস্কৃতিবিমুখতা মানুষকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। মানুষের মনকে কূপমূণ্ডকতা ও গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এর ছাপ ক্রমে ক্রমেই প্রকাশমান। সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চার অভাবে আমাদের শিশুকিশোরেরা এক ধরনের একাকীত্ব জীবন যাপনের অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বৈকল্যের জন্ম হচ্ছে। আর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নানা সামাজিক অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। মুক্তবুদ্ধি সৃজনশীলতার বিষয়গুলোকে নিরুৎসাহিত হয়ে যে শিশু বড় হচ্ছে তার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশি কিছু আশা করতে পারছে না এবং তারাই শিক্ষা লাভ করে হয়তো নানা পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। সেখানেই তাদের মাধ্যমে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আমাদের মনে রাখতে হবে সংস্কৃতিচর্চা মানুষকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করে তোলে, মানুষেমানুষে মমত্ববোধ ও সম্প্রীতি শেখায়, মানুষের সঙ্গে মানুষের এক স্বর্গীয় সম্পর্ক তৈরি করে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা শিশুকিশোরদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, যে বিশ্বাস তাদের বড় কোনো মঞ্চে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে।

শিশুকিশোরদের মন্দ চিন্তা থেকে দূরে রাখে, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে নতুন নতুন কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। সংস্কৃতির চর্চা দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে সুস্থ সমাজ বা জাতি গঠন অসম্ভব। আমাদের মনে রাখা দরকার বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য জাতিগত সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতেই ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ত্রিশলক্ষ প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছিলো। নানা বিচিত্র রস রং ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই সংস্কৃতি রক্ষা করা ও প্রগতির পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়াতে আমাদের নতুন প্রজন্মদের দায় অনেক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই সংস্কৃতির চর্চা থেকে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দূরেই সরে দিচ্ছেন। এর সুদূর প্রসারী দীর্ঘমেয়াদী ফল খুবই খারাপ। আজকের প্রজন্ম ও সচেতন নাগরিক সমাজ এই দায় যতই বলি এ দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। কিন্তু সমাজের নানা পারিপার্শ্বিকতায় তারাও যেন সময়ে সময়ে অসহায় হয়ে পড়েনএই অসহায়ত্ব আমাদের পীড়া দেয়। বাঙালি সভ্যতাসংস্কৃতিচর্চা টিকিয়ে রাখতে হলে সময়ের প্রয়োজনে কিন্তু সাহসীও হতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক,

বি এম সি ডিগ্রি কলেজ। চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা
পরবর্তী নিবন্ধনয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং কিছু স্মৃতি