নয়টি খালে পড়ছে চসিকের ১৪ ডাস্টবিনের আবর্জনা

ফেলছে সাধারণ মানুষও যারা খালে ময়লা ফেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কখন

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ৩ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ

খালনালায় ময়লাআবর্জনা ফেললে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিভিন্ন সভা থেকে প্রায় সময় নগরবাসীর উদ্দেশে এমন সতর্কবার্তা দেয়া হয়। অথচ খোদ সংস্থাটির ১৪টি ডাস্টবিন ও উন্মুক্ত নির্ধারিত স্থান থেকে প্রতিদিন বর্জ্য গিয়ে পড়ছে পৃথক ৯টি খালে। এতে ভরাট হচ্ছে খাল। বাড়ছে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি।

জানা গেছে, নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর গৃহীত ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনী প্রকল্পভুক্ত খালের পাড়ে থাকা চসিকের ডাস্টবিন এবং খালের যেসব পয়েন্টে সাধারণ লোকজন সরাসরি ময়লাআবর্জনা ফেলে তার ৩০টি স্পট নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে। গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রণীত ওই তালিকার তথ্য অনুযায়ী, চসিকের ডাস্টবিন ও নির্ধারিত স্থান থেকে এবং মানুষের সরাসরি ফেলা বর্জ্য পড়ছে পৃথক ১৭ খালে। এর মধ্যে ডাস্টবিন না থাকায় সরাসরি ১১টি খালের ভেতর ময়লা ফেলা হয় এমন স্পট রয়েছে ১৫টি। এছাড়া ৯টি খালের পাড়ে ১৪টি স্পটে ডাস্টবিন বা ময়লা ফেলার জন্য স্থান নির্ধারিত আছে চসিকের। তবে এসব ডাস্টবিনের কোনো কোনোটি ভাঙা। ফলে ডাস্টবিনে মানুষের ফেলা আবর্জনার প্রায় অর্ধেক পার্শ্ববর্তী খালে পড়ে যাচ্ছে। আবার ডাস্টবিন ভালো থাকলেও নানা কারণে এসব ডাস্টবিন বা নির্ধারিত স্থানের ময়লা খালে যাচ্ছে।

এদিকে খালে ময়লাআবর্জনা যাওয়ার সত্যতা মিলেছে চসিকের বর্জ্য নিয়ে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডে দৈনিক তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৮৩০ টন গৃহস্থালি, ৫১০ টন সড়ক ও অবকাঠামোগত এবং ৬৬০ টন মেডিকেল বর্জ্য। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে সিটি কর্পোরেশন সংগ্রহ করে দুই হাজার টন। বাকি বর্জ্য নালানর্দমা, খালবিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে।

জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সভায় খালে ময়লাআবর্জনা ফেলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়, খালনালা পরিষ্কার করার কয়েকদিনের মধ্যে আবারো ভরাট হয়ে যায়। ভরাটের উপকরণের বেশিরভাগ গৃহস্থালি বর্জ্য, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালামাল ও পলিথিন। তাই যারা এসব পণ্য খালে ফেলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে একাধিক সভায়। সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ক একটি সভায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেললে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।

এর আগে চসিক, সিডিএ ও চট্টগ্রাম চেম্বারের একটি সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যারা খালে ময়লা ফেলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনের খালনালায় মালামাল পাওয়া যাবে এবং যদি প্রমাণ হয় ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ফেলা হয়েছে তাৎক্ষণিক ওই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হবে। একইভাবে বাসাবাড়ির সামনেও বর্জ্য পাওয়া গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

গত বছর খাল পরিদর্শনে গিয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলার কারণে নালা ও খাল ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। যাদের বাড়ির সামনে, দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে, ড্রেনে, খালে ময়লাআবর্জনার স্তূপ দৃশ্যমান হবে তাদের বিরুদ্ধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন প্রয়োগ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা এখন কী বলছেন : মেগা প্রকল্পের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, ডাস্টবিন না থাকায় মানুষ খালে ময়লা ফেললে তার দায় চসিকের। কারণ তারা ময়লা ফেলার জন্য ওইসব এলাকায় স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারেনি। আবার ডাস্টবিন বা স্থান নির্ধারণ করে দিলেও সেখান থেকে খালে ময়লা গেলে তার দায়ও এড়াতে পারবে না চসিক।

এ বিষয়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ খালে ময়লা ফেলা। আমরা প্রকল্পভুক্ত খালগুলো পরিষ্কার করছি। কিন্তু লোকজন সেখানে ময়লা ফেলছে। এ বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিং করা উচিত।

তিনি বলেন, অনেকগুলো খালের পাশে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন রয়েছে। সেসব ডাস্টবিনের ময়লা গিয়ে পড়ছে খালে। অনেকগুলো ডাস্টবিন আছে ভাঙা। ওসব ডাস্টবিনের ময়লা এমনিতেই খালে গিয়ে পড়ে। আবার অনেক জায়গায় ডাস্টবিন নাই। তাই মানুষ খালেই ময়লা ফেলছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে প্রকল্পের সুফল মিলবে না।

এ বিষয়ে চসিকের অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, মানুষজন সচেতনতার অভাবে খালে ময়লা ফেলে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা দেয়। তিনি বলেন, ডোর টু ডোর ময়লা সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আমরা উন্মুক্ত ডাস্টবিনের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসছি। এরপরও অনেক জায়গায় ময়লা কোথায় ফেলবে তা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। এখন লোকজন ময়লা ফেলার স্পটটি দূরে হলে আলসেমি করে সেখানে নিয়ে যেতে চায় না। তারা আশেপাশে খোলা জায়গায় বা খালে ময়লা ফেলে দেয়। এখানেই সচেতনতার বিষয় রয়েছে।

১৭ খালে পড়ছে বর্জ্য : মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী স্থানীয়দের সরাসরি ফেলা বা চসিকের ডাস্টবিন থেকে বর্জ্য যাচ্ছে এমন ১৭ খাল হচ্ছে চাক্তাই খাল, চাক্তাই ডাইভার্শন খাল, বাকলিয়া খাল, রাজাখালী খাল, শীতলঝর্ণা খাল, মহেশখাল, মহেশখালী খাল, টেকপাড়া খাল, বদরখালী খাল, সদরঘাট খাল১ ও ২, বামনশাহী খাল, চশমা খাল, গয়নাছড়া খাল, খন্দকিয়া খাল, আজববাহার খাল ও নয়ারহাট খাল।

এর মধ্যে বাকলিয়া খালের রাহাত্তারপুল, মহেশখালী খালের ফইল্যাতলী ব্রিজের পাশে, চাক্তাই খালের মাস্টারপুল, বাড়ইপাড়া ব্রিজ, ফুলতলা, ধনিয়ারপুল ও মিয়াখান নগর, বদরখালী খালের সিটি কর্পোরেশন কলেজ এলাকা, বামনশাহী খালের কাজীপাড়া, শীতলঝর্ণা খালের আতুরার ডিপো ও আশেকান ডিগ্রি কলেজের পেছনে, সদরঘাট খাল১ এর পিকে সেন সাততলা এলাকা এবং চশমা খালের দুই নম্বর গেইট এলাকায় চসিকের ডাস্টবিন বা নির্ধারিত স্থান থেকে সরাসরি খালে ময়লা পড়ছে।

এছাড়া ডাস্টবিন না থাকায় আশেপাশের লোকজন খালের ভেতর ময়লা ফেলছেন রাজাখালী খাল৩ এর তিন নম্বর ব্রিজ এলাকায়, শীতলঝর্ণা খালের আশেকানে ডিগ্রি কলেজ এলাকায়, মহেশখালী খালের ফইল্যাতলী কাঁচাবাজার ও মন্ত্রীবাড়ি রোডের পাশে, চাক্তাই খালের সৈয়দ শাহ রোড, টেকপাড়া খালের বংশাল রোড ও এস আলম বিল্ডিংয়ের পাশে, মহেশখালের সুন্দরীপাড়া ও বড়পুল কাঁচাবাজার, চাক্তাই ডাইভার্শন খালের তক্তারপুল, গয়নাছড়া খাল২ এর তলতলা ও পুলিশ লাইন কর্পোরেশন ব্রিজ, খন্দকিয়া খালের বামনহাট ব্রিজের নিচে, আজববাহার খালের ঝর্ণাপাড়া ব্রিজ ও নয়ারহাট খালের বন্দর মুখে। আকবরশাহ সিলট্রাপের রসুনশাহ মাজার পাশাপাশি এলাকায় ডাস্টবিন না থাকায় সরাসরি খালে ময়লা ফেলছেন স্থানীয় লোকজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধষষ্ঠ ও সপ্তমের সব বইয়ে সংশোধনী আসছে
পরবর্তী নিবন্ধস্যানডর ডায়ালাইসিস কর্তৃপক্ষসহ ১২ জনের প্রতি হাইকোর্টের রুল