২৪ অক্টোবর, দু’হাজার বাইশ। সোমবার। পুরো দেশ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর দাপটে আতংকিত, কবে আঘাত হানবে উপকূলে। তিথিতে ঘোর অমাবস্যা। কালো আকাশ জুড়ে মেঘের এলোপাথাড়ি উড়ে যাওয়া, প্রচণ্ড বাতাসের দাপট, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কাঁপন ধরিয়ে দেয় শরীরে, মনে। সেদিন দীপাবলি ছিলো। সদানন্দময়ী শ্যামার আরাধনায় নিমগ্ন পুরো বিশ্ব চরাচর। কালী পুজোর নিকষ কালো রাত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুণ্যময়, আরাধ্য, পবিত্র আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠা প্রশান্তিময় পুণ্য রজনী।
মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। হুটহাট দু’একটি গাড়ির আনাগোনা। রাস্তার মাঝখানেই একটা জটলা পাকানো। এক মাঝবয়েসী মহিলা কাঁদছেন অঝোরে! যাকে পাচ্ছেন, তাকেই জড়িয়ে ধরছেন। তার সাত বছর বয়েসি কন্যা সন্তান নিখোঁজ হয়েছে বিকেল হতেই। গলির মুখে দোকান থেকে কিছু একটা কিনতে গিয়েছিলো, আর ফেরেনি। ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে দশটা ছুঁই ছুঁই। কতগুলো ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। জগজ্জননীকে আকুতি জানিয়ে এসেছিলাম সেদিন, সেই অসহায় মায়ের সন্তানকে যেনো ফিরিয়ে দেয়। তিনদিন পর! বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ নির্মম, মর্মান্তিক খবরটা কানে এলো। সাত বছর বয়েসী সেই ফুটফুটে কন্যা শিশুটির অর্ধগলিত বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া গেছে, তারই বাসার সামনের নর্দমায়।
সেদিনের প্রার্থনাটুকু তাহলে জগজ্জননী অব্দি পৌঁছাল না! কী আশ্চর্য! কী লোমহর্ষক! ঘটনার নির্মমতায় বাক্ রুদ্ধ হয়েছিলাম সেদিন। সত্যিই মরে গেলো মেয়েটি। মেরে ফেললো মেয়েটাকে, বাঁচতে দিলো না। আমার প্রতিবেশির দশবছরের মেয়েটা দু’রাত ঘুমাতে পারলো না। ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতায়। পুরো বিষয়টি না বুঝলেও সে এটা বুঝেছে মা–বাবার মধ্যিখানেও সে অনিরাপদ। যে কেউ অনায়াসে তাকে মেরে ফেলতে পারে। মাঝখানে চলে গেছে কয়েকটা দিন।এরই মধ্যে দু’জন শিশু নিখোঁজ হয়েছে। আশার কথা হলো, প্রশাসনের সদিচ্ছায় হোক বা কপালের বরাতেই হোক, তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। গত দশদিন আগে, আয়াত নামে আরেকটি কন্যা সন্তান নিখোঁজ হয়েছে। একই বয়েসী।
নিজের অজান্তেই বলছিলাম হয়তো, ‘একেও ফেরানো যাবে না’। ফেসবুকে মানুষের আহাজারি দেখছিলাম। ভাবছিলাম–এত প্রার্থনা কি পৌঁছাবে স্রষ্টা পর্যন্ত? পৌঁছাল না। সত্যিই পৌঁছাল না। সবার সব প্রার্থনাকে নিষ্ফল করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত খবরটা চাউর হলো। তারও বস্তাবন্দী খণ্ডিত মরদেহ বাড়ির সামনে পাওয়া গেছে। কী লোমহর্ষক ঘটনা। এরাও মানুষ! রক্তমাংসে তৈরি সৃষ্টির সেরা জীব।
খুব জানতে ইচ্ছে করছে চল্লিশোর্ধ্ব যে ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করলো বর্ষাকে হত্যার দায়ে, তার শাস্তিটা আসলে কতটুকু উপযুক্ত? অথবা তারও কি বাসায় একটা কন্যাসন্তান আছে? যাকে সেদিন রাতেও সে পিতৃস্নেহে আদর করেছিলো? হয়ত নেই, অথবা আছে। কন্যাসন্তান থাকলেও পিতৃস্নেহ অন্তত সে করেনি, করতে পারে না। কারণ এরা সত্যিকার অর্থে মানুষ নয়, পিতা নয়। এরা দেখতে মানুষের মতো, মানুষের খোলসে থাকা এরা একেকটা নরপিশাচ। পরপর এতগুলো বিভৎস ঘটনায় আতংকিত সবাই। তারই মাঝে মাইকে আরেকটি হারানো বিজ্ঞপ্তি –সিয়াম নামে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্র জামালখান–মোমিনরোড এলাকায় নিখোঁজ হয়েছে। সন্ধ্যার আলো আঁধারে শহরের নিয়ন বাতির আলোয় রাস্তা পার হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আমারই পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘মা, আরও একজন’!