আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের ভাবনা ও পরিকল্পনা

বিশ্বজিত গুপ্ত বিকু | শনিবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ৩ ডিসেম্বর। জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ৩০ বছর আগে। এই দিনটি এলেই আমার উপরে উল্লেখিত কথাগুলো মনে পড়ে। আমার মনে হয়আমরা প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। প্রতিবন্ধী নয়। আমাদের অনেকেরই এই সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সমাজকে, জাতিকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতি সম্প্রতি কল্পবিজ্ঞান লেখক ও বিদগ্ধ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লিখিত প্রতিবন্ধী নইমানুষ শিরোনামের একটি লেখায় তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হলো, হয়ত প্রতিবন্ধী শব্দটাই নতুন করে ব্যাখ্যা করা দরকার, তার কারণ, একজন একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিকে তারা সেটি পূরণ করে নিতে পারে, আমাদের শুধুমাত্র সেই সুযোগটি করে দিতে হবে।’ শ্রদ্ধা ভাজন জাফর ইকবাল এ প্রসঙ্গে লেখাটিতে তাঁর দেখা একাধিক দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন।

 

শ্রদ্ধেয় ইকবাল স্যারের কথা শিরোধার্য। কোন না কোনও কারণে কোনও মানুষ প্রতিবন্ধী হলে সে যে বড়, মহৎ বা স্মরণীয় কাজ করতে পারবে কিনা এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। প্রতিবন্ধী হয়েও যে চিরস্মরণীয় কাজ করার দৃষ্টান্ত বহু পাওয়া যায়। আমরা সকলেই জানি গ্রীক মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’, ‘ওডিসি’র স্রষ্টা হোমার ছিলেন জন্মান্ধ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম বিটোফেন ছিলেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী, হেলেন কিলার ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সুইডেনের নোবেল লরিয়েট সালমা লাগারেফ শৈশবে দুরারোগ্য রোগে পঙ্গু হয়ে গেলেও বিশ্বে তিনিই প্রথম মহিলা যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি যন্ত্র চালিত ঘোড়ায় চড়ে স্কুলেকলেজে লেখা পড়া করে শিক্ষয়িত্রী হয়েছিলেন।

পরিবারের বোঝা হননি। লাগায়েফ তাঁর কলের ঘোড়ায় চড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে ঘুরে পশু পাখিদের একত্রে অবস্থানিক মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণী মনোবৈজ্ঞানিকের ভাষায় লিখে ফেলেন বিখ্যাত বই দি ‘ওয়ান্ডার ফুল অ্যাডভেঞ্চার অব নিলস। এভাবে আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আমাদের কালেও আমরা দেখছি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কেবল একটি সচল আঙুলে কম্পিউটার চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন মহাকাশের নিগুঢ় তত্ত্ব। বস্তুত মানুষের প্রতিবন্ধকতা থাকলেও শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, থাকলেও সুযোগ, উৎসাহ প্রেরণা পেলে প্রতিবন্ধী মানুষ কাজের মানুষ হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে সে সব সুযোগ নেই। প্রতিবন্ধীদের এখনও অস্বাভাবিক অন্য গ্রহের মানুষ হিসেবে অপ্রতিবন্ধী মানুষেরা দেখতে অভ্যস্ত কী সমাজে, কী পরিবারে। এ কারণে প্রতিবন্ধীরা ও নিজেদের সমাজ বিচ্ছিন্ন মনে করে থাকে । এ জন্যে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না।

সর্বদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষ হবে শতকরা ১৫ জন। অথচ সত্তরের দশকেও ছিল শতকরা ১০ জন। এর অর্থ বিশ্বে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ শতাংশের বেশি বৈ কম নয়। কারণ যে দেশ যত বেশি দরিদ্র সে দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি হয়। যদি ধরেও নিই বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী তাহলেও বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় দুকোটি চল্লিশ লাখ।

এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী সমাজের মূল ধারার সঙ্গে একীভূত বা আত্মিকরণ করা না গেলে ঈন্সিত সমাজ উন্নয়ন তো হবেই না, উপরন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে না। এ বিশাল জনগোষ্ঠী মানব সম্পদ পরিণত হতে পারবে না। এ কথাটি স্মরণ করে দেয়া হয়েছে চলতি বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের ‘স্লোগান’ বা ‘থিমের’ মধ্য দিয়ে। ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের থিমবা প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-UN Theme- Transformative soluition for inclusive development the role of innovation in fueling an accessible and equitable world ’. মোদ্ধাকথা, প্রতিবন্ধীরাও মানুষএ ভাবনা নিয়ে একটি সমাজ গড়ে তোলার যে সব বাধা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে।

এটা করতে গেলে বিরাজমান বাধাগুলো শনাক্ত করে সেগুলি দূর করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্ম প্রয়াসের মাধ্যমে। বাধাগুলো দূর করে প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস যেমন গড়ে তুলতে হবে তেমনি অপ্রতিবন্ধীদের মধ্যেও প্রতিবন্ধীদের তাদের মতো, সমাজে আর দশজন মানুষের মতো মানুষ হিসেবেই ভাবতে হবে এবং এটা হতে হবে স্বভাবজাত, আরোপিত নয়। এটা প্রাথমিক কাজ। এ জন্য চাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি। আমাদের মধ্যে সেটা নেই। অপ্রতিবন্ধীরা এখনও প্রতিবন্ধীদের করুণার চোখে দেখে। এতে চলবে না। এদের মানুষ হিসেবেও সমপর্যায়ের মনে করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে এটা অনেকটা সম্ভব হবে।

আসলে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস ও কাজ অসম্ভবও সম্ভব হয়, ইংরেজ কবি মিল্টনের Paradise lost-এর কথায় বলা যায় United we stand divided we fall। একতাই শক্তি, একতাই বল। ঐক্যবদ্ধ হয়েই আমাদের প্রতিবন্ধীদের মানুষ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের মর্যাদা অর্জনের সকল বদ্ধ দুয়ার খুলে দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি সমাজ যে সমাজ মানব সমাজ যাতে প্রতিযোগিতা থাকলেও ‘থাকবে না প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিদ্বন্দ্বী ভেদাভেদ।

বাংলাদেশের অন্যতম হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী সেবা ও কল্যাণ সংগঠন, ‘কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড (সিএসডি)’ তার প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯৮ খ্রী. থেকে আজ পর্যন্ত যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সংঘে প্রতিবন্ধী দিবস পালনসহ তাদের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা প্রশিক্ষণসহ সিএসডি খুবই সোচ্চার। ‘সিএসডি’ এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা হতে বলা যায় যে হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন করতে হলে বিভিন্ন রকম আধুনিক বৃত্তিমূলক শিক্ষা কেন্দ্র প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এ দুর্লভ কাজ সুসম্পন্ন করতে হলে আবাসিক প্রতিবন্ধী ছাত্রাবাস একান্ত প্রয়োজন।

তাহলে ওরা দেশের মানব সম্পদে পরিণত ও সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়ে তুলতে পারবে। তা না হলে (বা করা না গেলে) প্রতিবন্ধীরা কখনো প্রতিযোগী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। ‘জীবন যুদ্ধে অনেক প্রতিবন্ধী’ প্রতিযোগী হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের কাজে, কর্মে ও প্রশিক্ষণে একটি পরিবেশ ও প্রতিবেশ বড়ই ফেক্টর। এরা সুযোগ পেলে অফুরন্ত জীবনী শক্তি, কারো নাকারো মত বড় হবার ইচ্ছাশক্তি ফিরে পাবে। আগামীকাল সূর্য উদয়ের আগে আমি যে প্রতিবন্ধী হবোনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই বলি সত্যই সুন্দর, সত্যকে গ্রহণ করো।

আমাদের প্রতিষ্ঠান কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড সিএসডি’তে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে আমাদের কার্যক্রমের সাথে প্রথম থেকে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট টিমের তামিম ইকবালের পিতা মরহুম ইকবাল খান, প্রফেসর ড. অনুপম সেন ও বাংলাদেশ সংবিধান প্রণেতা অধ্যাপক মরহুম মোহাম্মদ খালেদ, প্রাক্তন ভিসি মরহুম প্রফেসর ফজলী হোসেন, প্রাক্তন ভিসি মরহুম ড. আবু ইউসুফ আলম, . অলক রায়, প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, মরহুম প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, স্বর্গীয় কবি সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত, প্রফেসর শায়েস্তা খান, আহমদ খালেদ কায়সার, প্রফেসর অঞ্জন চৌধুরী, প্রফেসর ড. তাপসী ঘোষ রায়, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম (সোহেল), প্রফেসর ড. হানিফ সিদ্দিকী, জাতীয় ফুটবলার আশীষ ভদ্র, জাতীয় ক্রিকেটার আকরাম খান, প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রফেসর বেনু কুমার দে, উপউপাচার্য এবং ড. দানেশ মিয়া, প্রফেসর রাজশ্রী নন্দী, পোর্টল্যান্ডে গ্রুপের মিজানুর রহমান এবং চট্টগ্রামের মানব প্রেমী ব্যক্তিত্ব প্রতিবন্ধীদের জন্য নিরলসভাবে সহযোগিতা ও কাজ করে যাচ্ছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল চট্টগ্রাম আসছেন। আপনাকে আমরা শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানাই। দেশমাতৃকার প্রতি আপনার অঙ্গীকার সর্বজনস্বীকৃত। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আপনার মানবপ্রেম ধ্যানে প্রতিবন্ধী সংগঠন সিএসডি’কে পাশে রাখবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সিএসডি’র জন্য কোনও পতিত বা খাস জায়গা দয়াপরবশ হয়ে প্রদান করেন, সেখানে সিএসডি অসহায় হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে শতভাগ কাজ করে যাবে। ১৯৮৮ সালে ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলন করতে যাওয়ার পথে শাটল ট্রেনে আমার দুপা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। আমার জীবনকে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নিবেদন করেছি।

সিএসডি এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ও চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কার্যালয়ে নিবন্ধিত সংগঠন। সিএসডি এখনও কোনও বিদেশি দাতা বা এনজিও সহযোগিতা গ্রহণ করেনি। চট্টগ্রামের মানব হিতৈষী কর্মবীর সিএসআর সহযোগিতায় আমাদের পথচলা। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশেষ আবেদন এই যে, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে আমাদের সহযোগিতা করুন। আপনার সহযোগিতা পেলে প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক সহযোগিতায় প্রতিবন্ধীরা প্রতিযোগী হয়ে উঠবে।

লেখক : কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড সিএসডি’ও সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ক্রিকেটার

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৃশংসতার আর কত বাকি!
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে