নিঃসঙ্গ একাকী কিছু শব্দ

শাহেদা নাসরীন | মঙ্গলবার , ১১ মে, ২০২১ at ৪:৪৯ পূর্বাহ্ণ

‘অলক্ষ্মী, অসতী, কুলটা, ভ্রষ্টা, গণিকা, পতিতা, বেশ্যা, স্বৈরিনী, বারবণিতা, দেহোপজীবিনী’। এই শব্দগুলোর সবগুলোই শুধু স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত হয়, একজন নারীই শুধু এইসব বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে থাকে। অনেক খুঁজে এবং ভেবেও এই শব্দগুলোর বিপরীত লিঙ্গ বা পুরুষ বাচক শব্দ আমি কোথাও পাইনি। হয়তোবা আমার চোখে পড়েনি, হয়তোবা আমার জানার সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমার মনে হয় এই শব্দগুলো একজন নারীকে সমাজে নিকৃষ্ট হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এবং সমাজচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। একবার যদি এই শব্দগুলোর কোন একটি শব্দ একজন নারীর ললাটে লেখা হয়ে যায়, সে তখন কঠিন দুর্ভাগ্যে একা এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই হয়তো এই শব্দগুলোও ওই অসহায় নারীদের মতোই একা এবং নিঃসঙ্গ।
ভাবছি একজন নারী নষ্টা ভ্রষ্টা হওয়ার পেছনে একজন পুরুষেরও বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকে, একজন পুরুষ অনেক বেশী নোংরা কদর্য এবং দুশ্চরিত্রেরও হয়ে থাকে। কই তাদের জন্যে তো এতো এতো নেতিবাচক শব্দের বিপরীতে এমন পুরুষ বাচক শব্দ সৃষ্টি হয়নি।
একটা ধারালো অস্ত্র বা ভারী কিছু দিয়ে কোন বস্তু বা পাত্রে কঠিনভাবে আঘাত করলে সে বস্তু বা পাত্রটিতে আঘাতের চিহ্ন রয়ে যায়, কিন্তু যা দিয়ে আঘাত করলো তা বেশীরভাগ সময়ই চিহ্নিত করা যায়না বা আড়ালেই থেকে যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে নারী জাতি হলো আঘাতের চিহ্ন বহনকারী সেই বস্তু বা পাত্রেরই মতো। তাই খুব সহজেই তাকে চিহ্নিত করা যায়, বিশেষ শব্দে বিশেষায়িত করা যায়, অশালীন ভাষায় গালি দেয়া যায়, আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সমাজচ্যুত করা যায়, হেয় তুচ্ছ করা যায়, নোংরা পথে ঠেলে দেয়া যায়। অথচ এক্ষেত্রে একজন পুরুষ মূল অপরাধী হওয়ার পরও তাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সনাক্তও করা যায়না, বিশেষ শব্দে পরিচিতি দেয়াও হয়না। কারণ পুরুষ হলো সমাজের দন্ড মুন্ডের কর্তা। স্রোতের বিপরীতে চলতে চাওয়া হাতে গোনা কিছু নারী হয়তো আছে, কিন্তু বেশীরভাগ নারীই পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে সমাজে অচ্ছুত হয়ে যায়, সেই অসহায়ত্বের দায়ভার আমৃত্যু শুধু তাকেই বইতে হয় বলে বিশেষ শব্দগুলোও শুধুই তাদের পরিচিতি দানের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। তাই হয়তো শব্দগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ বা বিপরীত লিঙ্গের শব্দের জন্ম হয়নি। আমি একজন নারী হয়েও নারীবাদী মানসিকতা ধারণ করি না, আমার কাছে মানুষ পরিচয়টা সবচেয়ে বড়। শুধু নারীর জন্য সৃষ্ট নেতিবাচক শব্দগুলোর বিপরীতে পুরুষ বাচক শব্দের অনুপস্থিতির ভাবনা থেকেই আমার এই কথাগুলো মনে এলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশেষ শিশুর গর্বিত মা ঋতাভরী
পরবর্তী নিবন্ধরোমান্সে অ্যাকশন থ্রিলার