নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর ভূমিকা

নুসরাত সুলতানা | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:২৪ পূর্বাহ্ণ

এখন থেকে প্রায় ১৪০০ বছরেরও আগে পুরো আরব যখন পৌত্তলিকতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলো তখন মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে বিশ্ব জগতের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। অশান্তি আর বর্বরতায় পূর্ণ, সংঘাতময় আরবের বুকে আঁধারের বুক চিরে তিনি বিশ্ববাসীকে মুক্তি ও শান্তির পথে আহ্বান জানিয়ে মানবজাতিকে সত্যের, সভ্যতার ও ন্যায়ের দিকনির্দেশনা দিয়ে পুরো বিশ্বকে শান্তিতে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ থেকেই অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিনি চেষ্টা করেছেন নারীদের মুক্তির জন্যে। তিনি নারীদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে তৎকালীন বিশ্বে নারীর অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। নারীকে দেখা হতো ঘৃণার দৃষ্টিতে। কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। নারীর সেই ঘোর দুর্দিনে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার দিয়ে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ, কন্যা সন্তানের জন্মকে সুসংবাদ বলেছেন। ইসলামে কন্যা সন্তানের প্রতিপালন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। মা, স্ত্রী, কন্যা যেকোনোরূপেই নারী সম্মানিত। শৈশবেই মা আমিনা কে হারিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। দুধ মা হালিমাকে তিনি মায়ের মতোই শ্রদ্ধা, সম্মান করেছেন, ভালোবেসেছেন। নিজের গায়ের চাদর খুলে তাঁকে বসতে দিতেন। নীরবে সাহায্য করতেন এবং উপঢৌকন পাঠাতেন।
গর্ভধারীণী যে মা ছিলেন অবজ্ঞায় উপেক্ষিত, অবহেলার শিকার, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে সবকিছু থেকে ছিলেন বঞ্চিত, ছিলেন নিপীড়িত এবং নিষ্পেষিত সেই মায়ের জন্যেই প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’- এ কথা দিয়ে তিনি নারী জাতির মাথায় সম্মানের মুকুট পরিয়ে দিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কে আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে বললো, তারপর কে? তিনি আবার বললেন, ‘তোমার মা’। সে আবারো বললো, তারপর কে? তিনি আবারো বললেন, ‘তোমার মা’। সে পুনরায় বললো এরপর কে? তখন তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর জীবনে রয়েছে অতুলনীয় আদর্শ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিলো আনন্দে পরিপূর্ণ। তিনি তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটাতেন, বিনোদন করতেন। যা সব নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনের জন্য আদর্শ স্বরূপ। তাঁর পারিবারিক জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলোর কথা হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় উঠে এসেছে। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম স্বামী, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে’। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো স্ত্রীদের তিরস্কার করতেন না, কোনো বিষয়ে কটাক্ষ করে কথা বলতেন না। তিনি হৃদয় উজার করে মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে, আকর্ষণীয় ভাব ভঙ্গিমায় স্ত্রীদের সাথে বসে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করতেন ও বিভিন্ন কাহিনী শোনাতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তিনি আমাদের সাথে এমনভাবে হাসতেন, কথা বলতেন, বসতেন আমাদের মনেই হতো না যে, তিনি একজন মহান রাসুল’।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বাইরে থেকে ঘরে ফিরতেন তখন অত্যন্ত খুশি মনে দরদ মাখা কণ্ঠে সালাম দিতেন, কখনোই কোনো ব্যাপারে স্ত্রীদের দোষ ধরতেন না। সে সময় আরবদের মধ্যে রেওয়াজ ছিলো যে, নারীরা যদি কোনো ভুল করতো তবে তাদেরকে প্রহার করা হতো। এ বিষয়ে রাসূল (সা.) বললেন, ‘নারীরা আল্লাহ তা’লার দাসী, তোমাদের নয়। তাদেরকে কখনোই প্রহার করবে না’। তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না কিংবা তাকে প্রহার করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে কখনোই সৎ বলে বিবেচিত হবে না’। নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবী (স.) বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতেন। তিনি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নারীর অধিকার কায়েম করেছেন। পবিত্র কোরআনে ছেলেদের সাথে মেয়েদেরকেও পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে মা, স্ত্রী এবং কন্যাদের; পিতা ও স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় ভাই-বোনদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে আর কোনো ধর্মই এই পৃথিবীতে নারীদের অধিকার এভাবে প্রতিষ্ঠিত করেনি। রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদেরকে তাদের স্বামীদের সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের কিছু মর্যাদা আছে’। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.)বলেন, ‘সাবধান তোমরা নারী অর্থাৎ স্ত্রীদের জন্য মঙ্গলকামী হও। যেহেতু তারা তো তোমাদের হাতে বন্দিনী’। তিনি আরো বলেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ যেনো স্ত্রীকে ঘৃণা না করে। দোষ না ধরে। কারণ, সে তার একটা দোষ অপছন্দ করলেও অপর আরেকটা গুণে মুগ্ধ হবে’।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন উত্তম আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তিনি ঘরে বাইরে সকল কাজে সর্বোত্তম অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার পুরোটাই সম্পদ (স্বরূপ), তবে দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ হলো পূণ্যবান স্ত্রী’। তিনি তাঁর উম্মতদের শিক্ষা দিয়েছেন যে; স্ত্রীকে সাহায্য করা, স্ত্রীর সাথে বিনয়ী হওয়া, স্ত্রীর কাজে সহায়তা করা এবং স্ত্রীকে সুখ ও আনন্দ দানের জন্য সদা সচেষ্টা থাকা স্বামীর কর্তব্য। এতে স্বামীর সম্মান ও মর্যাদার বিন্দুমাত্র কমতি হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে’। এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, স্ত্রীদের সঙ্গে কখনোই প্রভুসুলভ আচরণ করেননি তিনি। তিনি ছিলেন বন্ধুর মতো। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নারীদের প্রতি ভালো আচরণের উপদেশ দাও, আর তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো’।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চরিত্র সর্বোত্তম আদর্শ ও সুমহান মর্যাদার অধিকারী। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রকৃত আবেগ ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তিনি। তিনি নারীদেরকে সম্মানজনক অবস্থান প্রদান করেছেন যা প্রত্যেক নারীরই পছন্দ। তাঁর সে আদর্শ গ্রহণ করলে স্বামীর নিকট সত্যিকার অর্থে একজন নারী অর্ধাঙ্গিনীতে পরিণত হতে পারে। একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের লালন পালন থেকে শুরু করে একটি পরিবারকে আগলে রাখেন একজন নারী। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে নারীর মর্যাদা উপলব্ধি করে তা রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন, আমীন।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধমায়ের অসুখে গর্ভ-সন্তান কীভাবে সুস্থ থাকবে