জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:২৩ পূর্বাহ্ণ

ফজরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

পবিত্র কুরআনের আলোকে ফজরের নামাযসহ পাঁচ ওয়াক্ত নাময: পবিত্র আল কুরআনে দৈনিক পাঁচবার ফরজ নামায যথা ফজর, যোহর, আসর, মাগরীব ও এশার নামায প্রসঙ্গে বিভিন্ন আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সুতরাং সালাত আদায় কর সন্ধ্যায় ও প্রভাতে এবং অপরাহ্নে ও যোহরের সময়ে। আর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সকল প্রশংসা তো তাঁরই জন্য। (সূরা: ৩০, আর রূম, পারা: ২১, আয়াত: ১৭-১৮) প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা কুরতুবী (র.)’র বর্ণনামতে আয়াতে বর্ণিত “তাসবীহ” শব্দ দ্বারা সালাত তথা নামায বুঝানো হয়েছে, প্রসিদ্ধ মুফাসসির হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)’র বর্ণনা মতে উপরোক্ত আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আরো বর্ণিত হয়েছে যে, নামাযের মধ্যে যেভাবে তাসবীহ রয়েছে অনুরূপভাবে উক্ত পাঁচ ওয়াক্তের সময়গুলোতে তাসবীহ পাঠ করার বড়ই ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পৃ: ১০৭৯)
মুফাসসিরকুল শিরোমনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন সন্ধ্যা দ্বারা মাগরিব ও এশা, প্রভাত বলে ফজরকে, অপরাহ্ন বলে যোহর এবং আসরের নামায কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “তোমরা সালাত কায়েম করবে দিবসের দুই প্রান্তভাগে এবং রজনীর প্রথমাংশে। নিশ্চয় সৎকাজগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয় মন্দ কাজগুলোকে এটা উপদেশ মান্যকারীদের জন্য উপদেশ। (সূরা: ১১ হুদ, পারা: ১২, আয়াত: ১১৪)
আয়াতে বর্ণিত দিনের দুই প্রান্তভাগের প্রথম প্রান্তভাগে ফজরের নামায, দ্বিতীয় প্রান্তভাগে জোহর ও আসরের নামায এবং রাত্রির প্রথমাংশে মাগরীব ও এশার নামাযের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আরো বহু আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (ফয়জুলবারী, খন্ড:২য়, বাদাইউস সানায়ে, খন্ড: ১ম)
হাদীস শরীফের আলোকে ফজরের নামায: ফজরের নামযের ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, “ যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে অর্থাৎ ফজর ও আসরের সালাত আদায় করে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং: ১৩০৯)
হযরত রাফে বিন খাদীজ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফজরের নামায আলো বিকশিত অবস্থায় পড়ো। এতে অনেক বেশী সওয়াব রয়েছে। (ইবনে মাযাহ শরীফ, হাদীস ৬৭২)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সূর্য উদয়ের পূর্বে ফজরের এক রাকাত পেল আর যে ব্যক্তি সূর্য অস্তের পূর্বে আসরের এক রাকাত পেল সে নামায পেল। অর্থাৎ তার নামায পূর্ণ হল। (তিরমিযী শরীফ)
ফজরের সুন্নাতের ফযীলত: উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাবীবাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দিনে রাতে ফরজ ছাড়া বার রাকাআত নামায পড়বে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে। চার রাক’আত জোহরের ফরজের পূর্বে ও দু রাক’আত পরে, দু’ রাক’আত মাগরিবের পরে, দু’রাক’আত এশার পর এবং দু’রাক’আত ফজরের পূর্বে। (তিরমিযী শরীফ)
ফজরের ফরজের পূর্বে দু’রাক’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ এর ব্যাপারে সর্বাধিক তাকীদ এসেছে। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ফজরের দু’রাক’আত সুন্নাত দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে এর চেয়ে উত্তম। (মুসলিম শরীফ)
স্ত্রীকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার ফযীলত: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহমত করুন, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায আদায় করে এবং আপন স্ত্রীকেও জাগায়ে দেয়। আর সে নিদ্রা হতে উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। এরূপে আল্লাহ রহমত বর্ষণ করুন সে স্ত্রীলোকের উপর, যে রাতে উঠে নামায পড়ে আর যদি সে উঠতে অস্বীকার করে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটায়ে দেয়। (আবু দাউদ শরীফ)
ফজরের ওয়াক্ত শুরু: ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয় সুবহি সাদিক থেকে এর লক্ষণ হল পূর্বাকাশে উষার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়া, সুবহে সাদিকের সময় হতে ফজরের সময় শুরু হয়। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
সূর্যোদয়ের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ফজরের সময় অব্যাহত থাকে।
নামাযের নিষিদ্ধ সময়: সূর্যোদয়, দ্বিপ্রহরের সময় ও সূর্যাস্তের সময়, এ সময়ে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত নফল, কাযা কোন ধরনের নামায জায়েজ নেই। ফজরের ফরজ নামায আদায়ের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যে কোন নফল পড়া মাকরূহ। ফজরের নামায ততোটুকু বিলম্ব করা মাকরূহ যাতে সূর্যোদয়ের ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। (আলমগীরি)
জামাত শুরুর পর সুন্নাত পড়া যাবেনা তবে ফজরের সুন্নত ব্যতিক্রম: জামাত শুরু হওয়ার পর কোনো প্রকার সুন্নাত পড়া জায়েজ নেই। তবে ফজরের সুন্নত আদায় শেষে জামাত পাওয়ার আশাবাদী হলে মসজিদের কোন অংশে সুন্নাত আদায় শেষে জামাতে শামিল হবে। (ফাতওয়া-এ রযভীয়্যাহ, খন্ড: ৩, পৃ: ৬১৪)
ফজরের সুন্নাত পড়তে গেলে জামাত শেষ হয়ে যাওয়ার ধারণা হলে তখন সুন্নাত না পড়ে জামাতে শামিল হয়ে যাবে। কারণ সুন্নাতের জন্য জামাত পরিহার করা গুনাহের কাজ। (আলমগীরি, ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ, খন্ড: ৩, পৃ: ৩৭০)
ফজরের বাদ পড়া সুন্নাত ফরজের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়া জায়েজ নেই। সূর্য একটু উপরে উটার পর কাযা পড়বে। (ফাতওয়া-এ রযভীয়্যাহ, খন্ড: ৩, পৃ: ৪৬২)
ঘুমন্ত ব্যক্তিকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতে হবে, ঘুমন্ত ব্যক্তি যিনি নামায আদায় করতে ভুলে গিয়েছে তার সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির দায়িত্ব হলো তাকে জাগিয়ে দেওয়া। ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকে নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় গুনাহগার হবে। (বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড, পৃ: ৭০১)
রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে নামায আদায় করতে ভুলে যায় বা নামাযের সময় ঘুমিয়ে যায় স্মরণ হওয়া মাত্রই নামায পড়ে নিবে। কেননা ঐ সময়ই হলো তার জন্য নামাযের সময়। (মুসলিম, হাদীস ৬৮৪)
ফজর ও আসরের সময় ফিরিস্তাদের দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়: আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত ফিরিস্তারা বান্দার আমলনামা লিখার কাজে নিয়োজিত আছেন। যারা ফজরের ওয়াক্তে আসেন তারা আসরের ওয়াক্তে চলে যান। আর যারা আসরের ওয়াক্তে আসেন তারা পরদিন ফজরের ওয়াক্তে চলে যান। আল্লাহ তা’আলা উভয়দলের ফিরিস্তাদের জিজ্ঞস করেন তোমরা আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় দেখলে, উভয়দল জবাব দেন, আমরা যখন তাদের নিকট পৌছি তখন তারা সালাতরত অবস্থায় ছিল আবার যখন ফিরে আসছি তখনও তারা সালাত আদায় করা অবস্থায় ছিল। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৫৫৫)। হে আল্লাহ আমাদেরকে যথাযথ সঠিক নিয়মে নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ
লালখান বাজার, খুলশী-১, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : এক নষ্টালজিয়ার উপাখ্যান
পরবর্তী নিবন্ধনারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর ভূমিকা