চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : এক নষ্টালজিয়ার উপাখ্যান

সাফিক চৌধুরী | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:২২ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬তম জন্মদিন। বৃহত্তর চট্টগ্রামতো বটেই বর্তমানে বাংলাদেশের একটি সর্বজনবিদিত শিক্ষা ও গবেষণার সূতিকাগার এই বিশ্ববিদ্যালয়। যার শিক্ষার্থী হতে পেরে আমরা গর্বিত। বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহু অনুষদ ভিত্তিক কোন গবেষনা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এ অঞ্চলের মানুষজন স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যা পরবর্তীতে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশিষ্টজন ও স্থানীয় দৈনিক আজাদী’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৬ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়েছি আজ প্রায় এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো প্রিয় ক্যাম্পাসে গেলে সেই প্রথম দিনের অনুভূতি গ্রাস করে প্রবলভাবে, রক্তে শিহরণ জাগে, নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। চবি ক্যাম্পাস শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রই নয় এ যেন এক প্রকৃতিরও পাঠশালা। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার নিভৃত ফতেপুর ইউনিয়নে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, বন্য প্রাণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, ফরেস্ট্রি এলাকাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিখ্যাত শার্টল ট্রেনের গান, ঝুপড়ির আড্ডা এছাড়াও কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের পেছনের দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে ঝরনা যে কোন নিরানন্দ মানুষের মনকেও চঞ্চল করবে আনন্দে ভাসাবে।
যে মানুষের শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের দীর্ঘ সময় শিক্ষা অর্জনে কাটে, শিক্ষায়তন তাঁর দ্বিতীয় মাতৃ জঠর। কারণ মানুষ একবার জন্মায় মাতৃ গর্ভে আর তাঁর দ্বিতীয় পুনর্জন্ম ঘটে শিক্ষায়তনে। তাই শিক্ষার্থীদের দ্বিজ বলা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মতো প্রাক্তন আর বর্তমান শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর। কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জীবনেই এই ক্যাম্পাস প্রথম ঘর ছেড়ে বাইরের জগতের খোলা আকাশ। তাই ছেড়ে আসা পরিবারের পিছুটান এড়াতে অচেনা বন্ধুদের সাথে ক্লাস আর পড়ালেখার ফাঁকে একটু বেশিই যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে হরিহর আত্মা বনে যাওয়া। নস্টালজিয়াও তাই একটু বেশি। আজকের ডিজিটাল বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের কারণে যদিও হারিয়ে যাওয়া অনেক বন্ধুকেই আমরা খুঁজে পাই, কিন্তু ফেবু/হোয়াটস অ্যাপে খুঁজে পাওয়া আর কাছে পেয়ে মন খুলে আড্ডা দেওয়ার সেই আনন্দ, কাটা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে শীতের রাতে আর ভীষণ রোদে বন্ধুর গলা জড়িয়ে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাওয়ার সুখ, জারুলতলা আর ২ নং আইন অনুষদের পাশের খেলার মাঠের আড্ডা, গান, মান-অভিমান আর কিছুতে কি পাওয়া যায়! প্রচণ্ড বৃষ্টি তে ১ নং রোড দিয়ে চবি রেল স্টেশনে বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে যাওয়া সে তো পরম পাওয়া! আর সব কিছুকে ছাপিয়ে শাটল ট্রেন আর সেখানে গলা ছেড়ে গান, সে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ! সেই গান আর আড্ডা যে শুনে নাই তাকে শুনে আসার আমন্ত্রণ জানাই! আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন আলোচনা এলেই এইসব কিছু আবারও মনে পড়ে যায়, নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই।
শুরুতে অল্প কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার (ছাত্রী প্রায় ৩৬ শতাংশ), শিক্ষক প্রায় ৯০০ জন (নারী শিক্ষক প্রায় ২১ শতাংশ), ৮টি অনুষদ, ৪৩টি বিভাগ, ১২টি হল (ছাত্র-৮টি, ছাত্রী ৪টি) ও হোষ্টেল ১টি। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে ৭টি ইনষ্টিটিউট, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র ও একটি রোকেয়া চেয়ার।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরদের আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই নির্মিত হয়েছে স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়াও চবিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু’র ম্যুরাল সংবলিত বঙ্গবন্ধু চত্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল। আর এগুলোই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও অহংকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।
যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই শুধু পঠন-পাঠন নয়। একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জন, সৃষ্টি ও তা বিতরণের পাশাপাশি গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর তা যে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা সম্মানিত ও পরিচিত করে তুলতে পারে তা টের পাওয়া যায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রয়াত অধ্যাপক বিশ্বখ্যাত ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের গবেষণাকর্ম ও তাঁর অর্জনে চোখ বুলালে। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি সারাবিশ্বে বিশেষভাবে খ্যাত। আর আমাদের ভাবতে ভীষণ গর্ববোধ হয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক ছিলেন, তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের ধারনাও প্রতিষ্ঠা পায় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন। এছাড়াও দেশবরেণ্য বহু শিক্ষাবিদ শিক্ষক হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন জ্ঞান ও গবেষণায় এগিয়ে যায়, তখন মূলত এগিয়ে যায় দেশ ও সভ্যতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যাশা, দেশের সার্বিক উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিগত দিনের মত ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা ও এবারের প্রেক্ষাপট
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা