নারীর প্রতি সহিংসতা

মর্জিনা আখতার | বুধবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সারা পৃথিবীতে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত ও অসহায়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নারীর প্রতি সহিংসতা। সহিংস অপরাধগুলো নারী বা বালিকাদের উপরই করা হয়। জাতিসংঘের ডেকলারেশন অব দ্য ডেকলারেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন থেকে বলা হয়, ‘সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষের মধ্যকার ঐতিহাসিক অসম ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে প্রধান সামাজিক কৌশলগুলোর মধ্যে একটি যার দ্বারা নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় অধীনস্থ অবস্থানে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া যায়।

জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনান ২০০৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড ফর উইমেন এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ঘোষণা করেছিলেন, নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান সমস্যা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে তিনজন নারীর অন্ততঃ একজনকে মারা হয়েছে, জোরপূর্বক যৌনক্রিয়া করতে বাধ্য করা হয়েছে বা অন্য কোনোভাবে তার জীবনে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে যেখানে নির্যাতনকারী কোনোভাবে তার পরিচিত ছিল।

সহিংসতার কোন কোন ধরন আছে যা ব্যক্তির দ্বারা ঘটে। যেমন ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, যৌন হয়রানি, প্রজননগত জোরজবরদস্তি, কন্যা শিশুহত্যা, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত, প্রসবকালীন সহিংসতা, উচ্ছৃঙ্খল জনতার দ্বারা সহিংসতা কিছু আছে আচারগত চর্চা। যেমন সম্মান রক্ষার্থে হত্যা, যৌতুক সহিংসতা বা পণমৃত্যু, নারী খৎনা, অপহরণপূর্বক বিবাহ বা জোরপূর্বক বিবাহ।

আবার রাষ্ট্রকর্তৃক ও কিছু কিছু সহিংসতা হয়। যেমন যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা যৌনদাসত্ব, জোরপূর্বক গর্ভপাত, পুলিশ ও কর্তৃত্বকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তার দ্বারা সহিংসতা। পাথর ছুঁড়ে মারা বা চাবুক মারা। আবার অনেকগুলো সহিংসতা সংগঠিত হয় অপরাধচক্রের দ্বারা। যেমন নারী পাচার বা জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নারীর জন্ম থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ধরন নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন সম্মেলন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন ডিরেক্টিভ এর সাহায্যে আন্তর্জাতিক মাত্রায় এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে ডিরেক্টিভ চাচ্ছে। এখানে ডিরেক্টিভ বলতে কোনো আন্তর্জাতিক সংঘের একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা লক্ষ্যমাত্রাকে বোঝানো হয়, যেখানে সংঘটির সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে সেই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণের উপায় সেখানে বলে দেয়া থাকে না।

পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক পরিবেশে সংঘটিত সহিংসতা বা অন্যান্য নির্যাতনকে বুঝায়। এটা বিপরীত লিঙ্গ বা একই লিঙ্গের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে থাকা কারো সাথে হতে পারে। স্বামী-স্ত্রী বা সঙ্গী বা পরিবারের যে কোনো সদস্যের সঙ্গে হতে পারে। এটি শারীরিক, মৌখিক, মানসিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন রকম হতে পারে।
জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের প্রধান মিশেল ব্যাশেমেট নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বলেন, ‘আমি পারিবারিক সহিংসতাকে না বলছি, ধর্ষণ এবং যৌন অপরাধকে না বলছি। জবরদস্তি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ককে না বলছি। আমি লজ্জা, অপমান এবং বৈষম্যের অবসান ঘটাতে জেগে উঠছি। আমি জেগে উঠছি নিপীড়নের শিকার এবং নির্যাতন থেকে বেঁচে আসা প্রত্যেকের জন্য।’

শুধু সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত দিকে নয়, প্রত্যেক ধর্মেই নারীকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। যার যার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার প্রতিফলন ঘটালে নারীর প্রতি সহিংস হওয়ার কোন সুযোগই থাকে না।

প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’। এ দিবসটির ইতিহাসে মিশে আছে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রপট। যা নারী সহিংসতারোধে চেতনা জাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে তিনজন নারী নির্যাতিত হন। এ ঘটনার স্মরণে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রথম লাতিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে ‘নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘ ‘নারী নির্যাতন দূরীকরণ ঘোষণা’ প্রকাশ করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করে। প্রতিরোধ দিবসের পক্ষকালে দাঁড়িয়ে আসুন সবাই সোচ্চার কণ্ঠে। বলি সমস্ত পৃথিবী থেকে নিপাত যাক, নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন। প্রতিটি নারীর জীবন হোক নিরাপদ এবং সম্মানজনক।

নারী ফিরে পাক তার ন্যায্য অধিকার। নারীকে শুধুমাত্র সমাজের অবলা ও অসহায় অংশ হিসেবে নয়, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবেই পুরো সমাজে পরিবর্তন আসবে। নারীকে নির্যাতিত ও বঞ্চিত না করে শক্তিতে পরিণত করতে পারলে, প্রতিটি রাষ্ট্রই নারীকে ও যোগ্য নাগরিক যোড়্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে বন্ধ হবে নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী পুরুষের বন্ধন হবে মৈত্রীময়।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের মাস ডিসেম্বর
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চেয়ে ১৪ দেশ ও ইইউর বিবৃতি