নাট্যকার ইয়োন ফসে’র সাহিত্যে নোবেল জয়

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী | শুক্রবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

নাটক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটাকে দুরূহ সাহিত্যশিল্প বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। এতে কাহিনি, চরিত্র, সংলাপ, ভাবনা, দৃশ্য (সাজসজ্জা) ও নাচগান ইত্যাদি উপাদান থাকে; মূলত এগুলোর উপরই নাট্যরসের সার্থক স্ফূরণ ঘটে। নাটকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এতে চরিত্র চিত্রন, ঘটনার বিন্যাস ও জীবন সত্যের উপস্থিতিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে হয়। নাটকে শিল্পাকর্ষ থাকলে তা নাট্যমঞ্চে তো বটেই, এর বাইরে সাহিত্য হিসেবে পাঠের মাধ্যমেও রস আহরণ করা যায়। নাটক সাহিত্য হয়ে ওঠার কারণে শেক্সপিয়ার, ইবসেন, বার্ণাড’শ, বেকেটের নাটক আজও পড়ে আমরা মুগ্ধ হই। নরওয়ের নাট্যকার ইয়োন উলাভ ফসে এব্যাপারে বেশ সচেতন। তিনি বলতে না পারা মানুষদের অনুচ্চারিত কথাগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য মূলত নাট্য সাহিত্যকে বানালেন তার শানিত হাতিয়ার। ১৯৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নরওয়ের হাউজ সুন্ডে জন্ম নেয়া এনাট্যকার তার ৬৪ বছরের জীবনে নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ ও শিশু সাহিত্য মিলে ৭০টি বই লিখেছেন। তবে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ ৪০টি বইই নাটকের। তাঁর চমকে দেয়ার মতো অভিনব কায়দায় লেখা গদ্য ও নাটক বঞ্চিত মানুষদের উজ্জীবিত করে। তাঁদের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, দোদুল্যমানতা, নিরাপত্তাহীনতা, জীবনমৃত্যুর প্রশ্নগুলোকে তিনি নিপুণ পারঙ্গমতায় ‘নৈকট্যের অনুভূতি’ স্পর্শে ছুঁয়ে গেছেন তার লেখনিতে। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ফসে তা জানতেন এবং এবিষয়ে বেশ সচেতন। তারপরও তিনি থমকে যাননি। বরং পরম দৃঢ়তায় তিনি সরব থেকেছেন; উদ্ভাবনী নাটক লিখে, নাট্য মঞ্চায়ন করে মানুষকে স্বশরীরে তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত নাটক ‘ওগ অলড্রি স্কাল ভি স্কিলজাস্ট (অ্যান্ড উইল নেভার বি রিভার্ট) ১৯৯৪ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ১৯৯৯ সালে প্যারিসে তাঁর নাটক ‘নকন জে তিল আ কোমে’ এর মঞ্চায়নের মাধ্যমে তিনি ইউরোপে নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি পান। বর্তমান বিশ্বের নাট্যশালায় এসময়ের সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হওয়া সফল নাটকের অন্যতম নাট্যকার তিনি। তাঁকে প্রখ্যাত নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন এবং নোবেল জয়ী অন্য নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার, স্যামুয়েল বেকেটের সমপর্যায়ে সম্মানিত করা হয়। অনেক নাট্য সমালোচক তাঁকে ‘নব্য ইবসেন’ নামেও অভিহিত করেন। তার নাটক ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম হোম’এ বেকেটের নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র প্রভাব লক্ষণীয়। শুধু স্বদেশে নয়, সারা বিশ্বে এক হাজারের বেশিবার মঞ্চস্থ হয়েছে তার নাটক।

তার নাটকসহ প্রায় সব লেখায় অনুচ্চারিত সব কথারা উচ্চকিত হয়ে কিলবিল করে মানুষের ভাবনা কেন্দ্রে নাড়া দেয়। এসব দিক ইঙ্গিত করে তিনি শুধু ‘পড়ার জন্য’ তার বই না পড়তে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শুধু গল্পের জন্য আমার বই পড়বেন না’। নিজের সৃষ্টিকর্মের প্রতি কতটা আস্থাশীল হলে একজন লেখক এমন নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠে বলতে পারেন, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমিও বিষয়টিকে স্বীকার করে বলেছেন, ‘অনুচ্চারিত সব কথা নিজের সৃজনশীল নাটক ও গদ্যে তুলে ধরার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে এপুরস্কার দেয়া হলো’। কিন্তু তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম, স্বকীয় লিখন শৈলী এতই উচ্চমার্গের যে, কোনো একক লেখার জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, যা অন্য নোবেল লরিয়েটদের বেলায় করা হয়। তাঁর সাহিত্য বিবিধ শৈলীতে বিস্তৃত। ফলতঃ নোবেল কমিটি বলেছে, ‘একক কোনো লেখার জন্য নয়, তাঁর রচিত বিপুল সাহিত্যকর্মের জন্যই পুরস্কারটি দেয়া হলো। কারণ, তাঁর সাহিত্যকর্মের ছোট তালিকা করা যায় না, সেটা করার চেষ্টাও অসম্ভব কঠিন।’

ইয়োন উলাভ ফসে’র বইগুলো নরওয়ের সবচেয়ে কম ব্যবহৃত ‘নাাইনক্স’ ভাষায় রচিত। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বোকমান ভাষায় কথা বলে। অন্যদিকে ‘নতুন নরওয়েজিয়ান’ নামে পরিচিত ‘নাইনক্স’ ভাষায় দেশটির মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ কথা বলেন। এত কম পরিচিত ভাষায় লেখালেখি করেও তিনি জনপ্রিয় লেখক হওয়ার নেপথ্যে কারিশমা ছিল তার লিখন শৈলীর অভিনবত্ব ও পাঠকের ভেতর ‘নৈকট্যের অনুভূতি’কে সঞ্চারিত করার পারঙ্গমতার নান্দনিক কৌশল। একই কারণে তাঁর লেখা বইগুলো দ্রুতই নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে দেশেদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের ৫০টিরও অধিক ভাষায় তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। অখ্যাত এক ভাষার মূল লেখক হওয়া সত্ত্বেও তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি প্রধানত অনুবাদের কল্যাণে। তার কাজ দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে প্রশংসিত হয়েছে। ইংরেজিভাষী বিশ্বেও তাঁর কদর কম নয়। এবার নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পারদ সর্বোচ্চ মাত্রা পাবে নিঃসন্দেহে।

সাহিত্যিক হিসেবে ইয়োন উলাভ ফসে’র আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৩ সালে ‘রাউথ, স্বার্ত’ ( রেড, ব্ল্যাক) উপন্যাস প্রকাশের মাধ্যমে। আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়আশয় তুলে ধরা এই উপন্যাসটি তাঁর পরবর্তী সাহিত্যকর্মকে প্রভাবিত করে। ইয়োন ফসে মূলত নাট্যকার হলেও সাহিত্যের নানা শাখায় রয়েছে তার অনন্য অবদান। তাঁর প্রশংসনীয় নাট্য গ্রন্থের মধ্যে ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম হোম’(১৯৯৬), ‘দ্য নেইম’ (১৯৯৫), ‘দ্য চাইল্ড’ (১৯৯৬), ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ (১৯৯৭), ‘দ্য সন’ (১৯৯৭), ‘অ্যা সামার’স ডে’ (১৯৯৯), ‘ড্রিম অব অটাম’ (১৯৯৯), ‘দ্য আইস’ (২০০৯) উল্লেখযোগ্য। আর উপন্যাসের মধ্যে ‘বোট হাউস’ (১৯৮৯), ‘মেলাংকলি’ ১ ও ২ (১৯৯৫৯৬), ‘মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং’ (২০০০), ‘সেপ্টোলজি’ (২০১৯, ২০২০, ২০২১), ‘ক্লোজ গিটার’ (১৯৯৫), ‘ব্লাড, দ্য স্টোন ইজ’ (১৯৮৭), ‘লিড এন্ড ওয়াটার’ (১৯৯২), ‘ওয়ইকফুলনেস’ (২০০৭) বেশ জনপ্রিয়।

তাঁর অন্যতম সাহিত্যকীর্তি হলো তার ৩টি ভল্যুমে প্রকাশিত ১২৫০ পৃষ্ঠার কোনো রকমের বিরামচিহ্নহীন সাতটি পরস্পরযুক্ত আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এই উপন্যাসের তৃতীয় ভল্যুম ২০২২ সালে বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। নোবেল পুরস্কারের আগে নরওয়ের প্রায় সবগুলো সাহিত্য পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে যোগ হয়েছে। এছাড়া তিনি ইবসেন প্রাইজ (১৯৯৬, ২০১০), ফ্রান্সের অর্ডার অব মেরিট পুরস্কার (২০০৩), সুইডিশ একাডেমি নরডিক প্রাইজ (২০০৭), ইউরোপিয়ান প্রাইজ ফর লিটারেচার (২০১৪) সহ অনেক পুরস্কার লাভ করেন এবং এতালিকা বেশ দীর্ঘ। নোবেল কমিটি তাঁকে স্যামুয়েল বেকেট, ফ্রানৎস কাফকা, টমাস বার্নহার্ট, জর্জ ট্রাকলের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের সাথে এক করে দেখেছেন। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ওলসনের কথায়, ‘অনেক দিক দিয়েই একজন চমৎকার লেখক ইয়োন ফসে। কেউ একবার তাঁর লেখা বই পড়লে, তা এমনভাবে তাকে ছুঁয়ে যাবে যে, তাকে তাঁর আরও বই পড়তে হবে’।

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ইদানীং কালে ‘আনপ্রেডিকটেবল’ বলেই মনে হয়। সম্ভাবনার তালিকায় না থেকেও অনেকে আচমকা নোবেল পেয়ে যান! তবে ইয়োন উলাভ ফসেকে নেটদুনিয়া বা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অপরিচিত মনে হলেও তিনি যে নোবেল জয়ের শর্ট লিস্টে কোনো সময় ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। ২০১৩ সালে তো তিনি নোবেল পেয়েই যাচ্ছেন ধরে নেয়া হচ্ছিল, বাজিকররা এনিয়ে বাজিও ধরেন ; যদিও সে বছর নোবেল জুটে কানাডার গল্পকার অ্যালিস মুনরো। নোবেল প্রাপ্তির ব্যাপারে ইয়োন ফসে নিজেও আশাবাদী ছিলেন। নোবেল প্রাপ্তির খবরে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানান, এতে তিনি ‘অভিভূত’ এবং একভাবে ‘ভীতও’। তবে তিনি এও বলেন, তাঁর জীবনে যে এমন এক দিন আসতে পারে, সেজন্য নিজের মনকে তিনি প্রস্তুুতও করেছিলেন।’ আসলে কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা, সততা, দায়বোধ ও বিরল সৃজনশীল ছিলেন বলেই নাট্যকার ইয়োন উলাভ ফসের পক্ষে সম্ভব হয়েছে সাহিত্যের নোবেল জয়, যা তার অবশ্যই প্রাপ্য ছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি সুবোধ সরকারের সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ
পরবর্তী নিবন্ধচবি সায়েন্টিফিক সোসাইটির এস্ট্রো অলিম্পিয়াড