নবরূপে লালদিঘি মাঠ : ইতিহাস ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের সমন্বয়

| বৃহস্পতিবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠ নবরূপে সেজেছে। উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সর্বসাধারণের জন্য। গত সোমবার দুপুরে সরকারি মুসলিম হাই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের মাধ্যমে মাঠটি খুলে দেয়া হয়েছে। ৩রা জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাঠটি সংস্কার কাজ শুরু করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মাঠের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। আগের ভাঙাচোরা সীমানা দেওয়ালগুলো সংস্কার করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ‘ছয় দফা মঞ্চ’। এছাড়া টেরাকোটার কারুকাজে আঁকা হয়েছে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি স্মারক। ধূসর বালির ময়দানকে মোড়ানো হয়েছে সবুজ ঘাসে। সংস্কার কার্যক্রম শেষে ২০২১ সালের স্বাধীনতা দিবসে মাঠটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। সংস্কার কাজ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় প্রায় দেড় বছর মাঠটি টিনের ঘেরায় ‘অবরুদ্ধ’ ছিল।

সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে অন্যান্য ২৮টি প্রকল্পের পাশাপাশি ‘লালদীঘি মাঠ আধুনিকায়নের’ এ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের পরও মাঠটিতে খেলাধুলার সুযোগ পায়নি শিক্ষার্থীরা। এর একমাসের মাথায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের মাধ্যমে অবশেষে মাঠটি উন্মুক্ত করা হলো। গত সোমবার দুপুরে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আনুষ্ঠানিকভাবে লালদিঘি ময়দান সরকারি মুসলিম হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে যতদূর জানা যায়, ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন সম্বলিত দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্য, মঞ্চ আর সবুজ ঘাস ও টেরাকোটার কারুকাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নগরীর ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানকে। ঐতিহাসিক এ ময়দান বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ ময়দান থেকেই বারবার গর্জে উঠেছিল ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসন বিরোধী নানা আন্দোলন সংগ্রামের হাজারো প্রতিবাদী কণ্ঠ। বাংলাদেশ, ভারতসহ অত্র অঞ্চলের অগুনতি নেতৃত্বের পদচিহ্ন পড়েছে এ লালদিঘির ময়দানে। দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের ঐতিহাসিক ৬ দফার ঘোষণা এ মাঠেই দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৬ দফার ঘোষণা করা হয়েছিল যেদিন, সেদিন ছিল শুক্রবার। বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে এসেছিলেন সেদিন সকালে। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি রেস্টহাউসে। কিন্তু তিনি সেখানে থাকেননি। গিয়ে উঠেছেন হোটেল শাহজাহানের ৭ নম্বর কক্ষে।

ছয় দফার জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছেন ছয় দফায় কী কী আছে।

বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্বলিত ছয় দফার যে পুস্তিকাটি সেদিন বিলি করা হয়েছিল, সেটি অসাধারণ সুন্দর গদ্যে লেখা। বাঙালি জাতিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের কথা লিখেছেন, ‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে সকল শ্রেণির সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে।’

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের এমন কোনো সরকার প্রধান কিংবা দলীয় প্রধান নেই যিনি লালদিঘির মাঠে ভাষণ দেননি। স্বৈরাচার বিরোধী নানান আন্দোলন, সংগ্রাম, বিক্ষোভে লক্ষ লক্ষ জনতার পদভারে প্রকম্পিত হওয়ার ইতিহাসও রয়েছে লালদিঘি ময়দানের। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসের কালের সাক্ষী এ মাঠ সাজেছে নতুন রূপে। মাঠের যে স্থানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে তৈরি হয়েছে মুক্তমঞ্চ। ন্যাড়া বালুময় এই মাঠে বিছানো হয়েছে সবুজ ঘাস। আর দেওয়ালে খোদাই করে বসানো হয়েছে ছয় দফাসহ ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিবরণ। তৈরি হয়েছে ওয়াক-ওয়ে।

ঐতিহাসিক এই লালদিঘি মাঠের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে একটা দিকনির্দেশনা শিক্ষা উপমন্ত্রী দিয়েছেন। মাঠটি আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আগে যেভাবে বুকিং দিয়ে সভা-সমাবেশ করেছে, সামনেও একইভাবে করতে পারবে। সিটি করপোরেশন এ মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। জেলা প্রশাসনের একটি কমিটি থাকবে। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কার্যক্রেমের অনুমোদন এ কমিটিই দেবে।
সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা কাজ হয়েছে বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটানোর প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে