দ্বার খুললো পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের

স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামবাসী কখনও মাথা নত করেনি : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং একাত্তরের প্রতিরোধ যোদ্ধা পুলিশের স্মৃতি বিজড়িত দুটি ভবন নিয়ে গড়ে তোলা ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এর উদ্বোধন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনসে এ জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। আর একাত্তরের ২৫ মার্চ প্রথম প্রহরে রাজারবাগের মত দামপাড়া পুলিশ লাইনেও আক্রমণ হয়েছিল, যা প্রতিরোধ করেছিল পুলিশ সদস্যরা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মেলবন্ধন তৈরি করা এ জাদুঘর গড়ে তোলার জন্য চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনারকে ধন্যবাদ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, এ উদ্যোগের ফলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামবাসী কখনও মাথা নত করেনি। সবসময় মাথা উঁচু করে থেকেছে, যার স্বাক্ষর এ জাদুঘর।
সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম, সাংসদ এম এ লতিফ, সাংসদ নজরুল ইসলাম, সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শ্যামল কুমার নাথ, জেলা পুলিশ সুপার এস এম রাশিদুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনের পর জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পাশাপাশি দুই লাল ভবন। দুই ভবনের প্রথমটি ছিল ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার, ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে এক দল বিপ্লবী সেই অস্ত্রাগার লুট করে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের পতাকা। রচিত হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের’ ইতিহাস। আবার ১৯৭১ সালের মার্চে ইতিহাসের আরেক যুগ সন্ধিঃক্ষণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা দ্বিতীয় লাল দালান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন অন্তত ৮২ জন পুলিশ সদস্য। প্রায় ছয় হাজার বর্গফুট আয়তনের এ জাদুঘরে তৎকালীন ব্রিটিশ স্থাপত্য ঠিক রাখা হয়েছে। এখানে ঠাঁই পেয়েছে ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্যদের ছবি, ব্যবহৃত অস্ত্র এবং তাদের ব্যবহৃত পোশাকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্য সেনের ফাঁসির মঞ্চের একটি রেপ্লিকাও রাখা হয়েছে এ জাদুঘরে। জাদুঘরের একটি অংশে আছে বঙ্গবন্ধু কর্নার, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্মারক ও নথি স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সুপার এম শামসুল হকের স্মারক হিসেবে তার র‌্যাংক ব্যাজ, পোশাকসহ ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস এবং শহীদ আরআই আকরাম হোসেনের স্মারক হিসেবে তার ব্যবহৃত রেডিওটি এ জাদুঘরে সংগৃহীত আছে। স্থান পেয়েছে অন্যান্য শহীদ পুলিশ সদস্যের অস্ত্র ও জিনিসপত্র।
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই অস্ত্রাগারের ইতিহাস জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে জাদুঘর নির্মাণের জন্য সিএমপি কমিশনারকে ধন্যবাদ জানান। মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে সদ্য একুশে পদকপ্রাপ্ত এ বরেণ্য সংবাদ ব্যক্তিত্ব বলেন, চট্টগ্রাম সবসময় এগিয়ে। সেই যে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তদের মত ত্যাগী বিপ্লবীরা চট্টগ্রামকে তিনদিন স্বাধীন রেখেছিলেন। আজকে সেই অস্ত্রাগার লুন্ঠনের স্মৃতিধন্য জায়গাটিকে সিএমপি কমিশনার একটি জাদুঘরে পরিণত করেছেন। আমি অনেক সময় ভাবি, জাদুঘর কেন বলা হয়? আসলে জাদুঘরে প্রবেশের পর যেকোনো পুরাকীর্তি বা দর্শনীয় বস্তু দেখে আপনি কল্পনায় সেই সময়টাতে সেই জায়গায় নিজেকে খুঁজে পাবেন। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে; তারাও এদেশকে ভালোবাসবে, অর্জিত স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে তারা উদ্বুদ্ধ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তারা জানবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে একটি জাতিকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমি মনে করি, তিনি যুগ যুগান্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি আমাদের একটি লাল সবুজের পতাকা দিয়ে গেছেন। একুশে পদক পাওয়ায় মৃত্যুর পর সেই লাল সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত থাকবে আমার কফিন, এটা আমার কাছে পরম আনন্দের।
উল্লেখ্য, দর্শনার্থীরা প্রবেশ ফির বিনিময়ে জাদুঘরটি দেখার সুযোগ পাবেন। এ জন্য দামপাড়া পুলিশ লাইনসের ফটকের পাশে আলাদা একটি ফটক তৈরি করা হচ্ছে দর্শনার্থীদের জন্য। জাদুঘর উদ্বোধন হলেও দর্শনার্থীদের জন্য পুরোপুরি খুলতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। জাদুঘরের ভেতরে ছোটোখাট কিছু কাজ শেষ করে তবেই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। তবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দর্শনার্থীরা এ জাদুঘর দেখতে পারবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভয়াল কালরাত আজ
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে আবাসিক হোটেলে যুবকের ঝুলন্ত লাশ