বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘খুলে দাও দ্বার’ কবিতার পংক্তি উপস্থাপনে দৈনিক আজাদীর জন্মদিনে নিরন্তর শুভেচ্ছা নিবেদন করতে চাই। পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা পরিশুদ্ধ সমাজহিতৈষী-শিক্ষানুরাগী ও আধ্যাত্মিক শক্তিময়তায় ঋদ্ধ মাটি ও মানুষের অন্তরের ব্যক্তিমানস প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবকে। ‘খুলে দাও দ্বার;/ নীলাকাশ করো অবারিত;/ কৌতূহলী পুষ্পগন্ধ কক্ষে মোর করুক প্রবেশ;/ প্রথম রৌদ্রের আলো সর্বদেহে হোক সঞ্চারিত শিরায় শিরায়;/ আমি বেঁচে আছি, তারি অভিনন্দনের বাণী/ মর্মরিত পল্লবে আমারে শুনিতে দাও;/ এ প্রভাত আপনার উত্তরীয়ে ঢেকে দিক মোর মন/ যেমন সে ঢেকে দেয় নবশষ্প শ্যামল প্রান্তর।’ উল্লেখ্য পংক্তিতে চিত্রিত দ্যোতনায় প্রযোজ্য বিষয় হচ্ছে এই, বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীর হৃদয় গভীরে অবারিত উদার আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো রাত্রির তপস্যা ও প্রভাত প্রহরে নিত্যদিনকালের নানামুখী ঘটনা প্রবাহের নিগূঢ় উম্মোচন প্রতীক্ষা। সূর্য ওঠার আগেই সকালের পাখির কলকাকলির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মানুষকে জাগ্রত করার যে অনবদ্য ভূমিকা বিগত ৬১ বছর দৈনিক আজাদী পালন করে আসছে; তা একটি নবতর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টির স্মারক হিসেবে ইতিমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বত্রই সমাদৃত। প্রগাঢ় মিনতিরাশির মধ্যেই লুকিয়ে থাকা দৈনন্দিন জীবনচক্রের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনার আবাসনে আন্তর্জাতিক-দেশীয়-আঞ্চলিক বিভিন্ন সংবাদ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদনসহ অন্তরের আরাধ্য আকাঙ্খাকে রাতের আধার দূরীভূত হওয়ার প্রাক্কালেই দৈনিক আজাদীর বিচরণ ব্যতিরেকে যথার্থ অর্থে দিনমানকে সচল রাখা কোনভাবেই সার্থক হয়ে ওঠেনা। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই দেশবাসী বিশেষ করে চট্টগ্রামের নগর-শহর-গ্রামীণ জনপদেও সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি উন্মীলিত হয় স্বকীয় ভঙ্গিমা-শৈলী-সত্ত্বায় উদ্ভাসিত দৈনিক আজাদীর প্রতি পৃষ্ঠার প্রতিটি বাক্য-শব্দ চয়নে।
বিভিন্ন বিজ্ঞ গবেষকদের উদ্বৃতি থেকে জানা যায়, আঠারো শতকে ইউরোপে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হলেও এ উপমহাদেশে মুদ্রন সাংবাদিকতা শুরু হয় ১৭৮০ সালে কলকাতায় ‘হিকির গেজেট’ প্রকাশের মাধ্যমে। ‘বাংলা গেজেট’, ‘দিকদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্শন’ পত্রিকা প্রকাশে ১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতার প্রকাশ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭’র দেশবিভাগ এবং পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকার উত্থান ইত্যাদি সাংবাদিকতার বিস্তারে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
১৯০০-৪৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশ নানা মাত্রিকতায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা সীমিত হলেও তথ্য প্রবাহের গতিশীলতা ও মেধা-জ্ঞান সৃজন-বিতরণে অপরিমেয় অবদান অনিস্বীকার্য। উল্লেখ্য সময়ে বাংলায় ১৭৩টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে আনুমানিক ৬৫টি মুদ্রিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে। ভারত ভাগের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সংবাদপত্র ও সাময়ীকির সংখ্যা ১৬০ এ হ্রাস পায়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে পত্রিকাগুলো ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তি-দলের পৃষ্ঠপোষক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশকিছু সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ থাকে এবং অনেক পত্রিকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলে যায়। এসময় শাশ্বত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, বাংলার বাণী, বিল্পবী বাংলা, দ্যা নেশন, মুক্ত বাংলা, দ্যা পিপল, দুর্জয় বাংলা, মুক্তি, একতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ইত্যাদি পত্রিকা হানাদার মুক্ত এলাকা ও ভারত থকে প্রকাশিত হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় মুহূর্তে বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০টি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলো ছিল স্বৈর শাসকের নিয়ন্ত্রণে। সে সময় স্বৈরশাসকের সমালোচনামূলক সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে প্রায় ৫০টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকের প্রকাশনার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়; আশির দশকের শেষে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে মূলধারার সাংবাদিকতার বাইরে প্রতিবাদী সাংবাদিকতায় কার্টুন প্রচ্ছদ সম্বলিত কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা সরকারের বিদ্রুপাত্মক সমালোচনায় সোচ্চার থাকত। ১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬, ১৭ এবং ১৮ নং ধারা অবলুপ্ত এবং সেন্সরশিপ ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত কালো আইন বিলুপ্ত করে। ঐ সময় প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশ অ্যাক্ট সংশোধন হওয়ায় রেকর্ড সংখ্যক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে দেশে
মোট পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৬৬৯ টি যা পরবর্তী বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪০ এ উন্নীত হয়। ২০০৭ সালে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তথ্যানুসারে বাংলাদেশ থেকে নিবন্ধনকৃত ৫৭৭ পত্রিকা বের হতো, যার মধ্যে ২৭৩ টি ঢাকা থেকে এবং ৩০৪টি ঢাকার বাইরে। কালের পরিক্রমায় পরবর্তীতে যুগের চাহিদায় সংবাদপত্রের সাথে নতুন সংযোজন ঘটে টেলিভিশন, বেতার ও চলচ্চিত্রসহ নানা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টিলিভিশনের যাত্রা শুরু হলেও মূলত স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যাত্রা শুরু ১৯৯২ সালে। ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এসটিভিআর (স্যাটেলাইট টিভি রিসিভার) এর বৈধতাদানে দেশে বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি সম্প্রচার চালু হয়। গণমাধ্যমের অন্যতম বাহন রেডিও যাত্রা শুরু করে ১৯৩৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা কেন্দ্র চালুর মধ্য দিয়ে।
এটি সর্বজনবিদিত যে, সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় অতীতের যে কোন উৎপাদন ব্যবস্থার তুলনায় আধুনিক পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের যুগে সমাজের সার্বিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী। ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রেক্ষাপটে স্বরূপ প্রকাশের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক কালে অবাধ সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এর বহু মাত্রিকতার গুরুত্ব নিবিড় গবেষণার দাবি রাখে। এই যুগ সন্ধিক্ষণে গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্রের প্রচার ও প্রসারে বিষয়বস্তু নির্বাচন, প্রযুুক্তিগত কৌশল, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য, বিপণন ব্যবস্থা সকল কিছুই উদ্দিষ্ট ষ্টেকহোল্ডারদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বর্তমান গণমাধ্যম বৈশ্বিক পরিসীমা ও ভৌগোলিক চৌহদ্দির অনন্য ভারসাম্যের ফলশ্রুতিতে গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন উপযোগিতার বিশালতায় সমৃদ্ধ। শূন্য থেকে সর্বোচ্চ খ্যাতি-সুখ্যাতির সুনিপুণ রসায়ন তৈরি করে জাগতিক এক অনুবন্ধ আবিষ্কারে গণমাধ্যমের বিভাজিত বিস্তার ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধও হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত যোগাযোগ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গর্ডন বলেন, পাবলো পিকাসোর চাইতে বড় মাপের চিত্র শিল্পী হয়েও ওলফগ্যান্গ মজার্র্ট শিল্পবিপ্লব বা আধুনিক গণমাধ্যম প্রসার যুগের পূর্বে জন্মেছিলেন বলেই অতি কষ্টে তাঁকে জীবনধারণ করতে হয়েছিল, অথচ প্রচার যুগের বিশেষত্বের কারণে পিকাসো খ্যাতি লাভ করে একটি মাত্র ‘স্থির জীবন-চিত্র’র বিনিময়ে ফ্রান্সের দক্ষিণে একটি বাড়ী কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যার প্রচার-অপপ্রচারে গণমাধ্যমের ভাবমূর্তির প্রচার-প্রসার সমধিক অর্জন-বিসজর্নে পরিপূর্ণ।
জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন-অনুন্নয়ন আলোচনা-সমালোচনায় গণমাধ্যম সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও পরিবেশনায় অভীষ্টতম লক্ষ্যে জ্ঞানাঞ্জন ছিল। গণমাধ্যমের নবতর বিকাশ, বিস্তার, বিতরণ, বিনিয়োগ, উদ্ভাবন তথ্য বিপ্লবের কালান্তরে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। লুম্পেন বিশ্বায়নের মোড়কে বৈশ্বিক সংস্কৃতির কাঠামো, প্রযুক্তি, বিনোদন, মুদ্রিত উপাদান, সাহিত্য, চিত্রকলা, বেতার, টেলিভিশনসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি চলমান সভ্যতার বশীভূত সংযোজন। সংস্কৃতির বস্তু ও অবস্তুগত প্রজ্ঞপ্তির জটিল মিথস্ক্রিয়ায় সততা-নৈতিকতা-সত্যবাদিতা-শুদ্ধাচার আপেক্ষিক পরিশুদ্ধ সমাজে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত। অশঙ্ক পরিকল্পনায় একদিকে নির্মিত হয়েছে আগ্রাসনবৃত্ত, অন্যদিকে পর্যুদস্ত ঐতিহ্য-কৃষ্টির ভৈরবী। বৃহত্তর সমাজের বৈষম্যের বিরাজিত যুগপৎ সংকট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদকেই পক্ষান্তরে দীপনীয় করেছে নির্ভরশীলতার নতুন কদর্য দিগন্ত। সুশাসন বা সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার যৌগিক গতিময়তা বৃহত্তর পরিসরে একধরণের নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যাহ্নিক বলয় অতিক্রম করছে। সৎ-যোগ্য-মেধাবী-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন যেন সমাজে অবমূল্যায়নের তলানিতে এসে ঠেকেছে। বড়ই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত আলোকময় এই জগৎ। পরিবর্তিত এহেন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ট-সত্যনিষ্টতা চর্চার তাৎপর্য অতীব জরুরী। এই ক্ষেত্রেই দৈনিক আজাদীর প্রজ্জ্বলন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে গৌরবমন্ডিত ও দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় দীপ্যমান।
সত্যমানস, জ্ঞানঐশ্বর্যের প্রবুদ্ধ ধারক-বাহক এখনো বৈদগ্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করে উপলব্ধি করতে চায় – গণমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ ব্রতী হয়ে প্রবর্তমান অনুন্নয়নের উন্নয়ন নয়; বরং গণউন্নয়নের উন্নয়ন সংস্কৃতিকে জাগ্রত রাখবে। গণবিচ্যুত গণমাধ্যম অপসংস্কৃতির নষ্টধারাকে বিশ্বময়তাদানে উন্নয়নশীল বিশ্বকে কতটুকু নির্মমভাবে প্রভাবিত ও দুর্বৃত্তায়নের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারদর্শী, সচেতন বিশ্বজনীন মানবতাবাদি বিবেকবান মানুষের বোধে তা অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। প্রসঙ্গত: মহাত্মা গান্ধীর অমিয় মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই – ‘আমি আমার ঘরটিকে চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত ও আমার জানালাগুলি বন্ধ রাখতে চাইনা। আমি চাই সকল দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরের চারপাশে যত ইচ্ছা স্বাধীনভাবে এসে ভিড় করুক। কিন্তু তার কোনটি আমাকে স্থানচ্যুত করবে সেটা আমি হতে দেব না।’ প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা, ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ, জ্ঞান আহরণ-বিতরণ ও সৃজনের প্রতিকী প্রকৃতি-প্রবাহ এবং পরিকর্ষ মানদন্ডে এর প্রায়োগিক বিনিময় আজকের দিনে গান্ধীজীর অমূল্য মন্তব্য কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ তা বিবেচনার দাবি রাখে। বস্তুতপক্ষে গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ, স্যাটেলাইট সংস্করণ, ফেইসবুক, ইন্টারনেট ইত্যকার ক্রমবর্ধমান উপকরণসমূহ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে কতটুকু জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে – তা নিয়ে সমুদিত সংশয় অত্যধিক প্রবল।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে; বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে অতিস্বল্পসংখ্যক গণমাধ্যম এবং গুটিকয়েক ব্যক্তি সাংবাদিক মুখোশধারী অপসাংবাদিকতায় লিপ্ত থেকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রহনন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নানাবিধ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা-বিদ্বেষমূলক-প্রতিশোধপরায়ণ হয়রানির নিকৃষ্টপন্থা অবলম্বন করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে ব্যতিব্যস্ত থাকে। হিংস্র বন্যপশুর রক্তপ্রবাহে যেন এদের জন্মরহস্য নির্ধারিত। অপরিমেয় অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাবলিপ্সু মেধাশূন্য ও অযোগ্যতায় প্রতনু অতিমাত্রায় উচ্চাবিলাসী পদ-পদক-পদবী আদায়ে নির্লজ্জ ছলচাতুরী-প্রতারণায় অভ্যস্ত ঘৃণ্য-নপুংসকদল এসব কথিত কবি-সাংবাদিক-কলামিষ্ট-প্রাবন্ধিকগোষ্ঠী প্রণোদিত এবং প্রণমিত সহায়তাপ্রাপ্ত হয়ে তাদেরই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে পবিত্র সাংবাদিকতা-গণমাধ্যম জগতকে বিশ্বব্যাপী করছে নিদারুণ অপবিত্র ও কলুষিত। এ প্রসঙ্গে বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার – নোবেল প্রাইজ প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলকে গভীর স্মরণে আসছে। তিনি পরিহাস করে নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোনো ডাক্তারের উচিত ছিলো জন্ম মুহুর্তে তাঁর শোচনীয় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ : তিনি অর্থলোলুপ ছিলেন না।’ এই কঠিন সত্যকে যাঁরাই ধারণ করছেন তাঁরাই প্রতিমুহূর্তে সমকক্ষতা পরাভূত ব্যক্তি-গোষ্ঠীসৃষ্ট নির্মম সংকটে নিপতিত হচ্ছেন। এই বিপ্রতীপ সংশ্লেষ পুরো সমাজকেই বিপন্ন নির্বন্ধতায় আলোকনিবারিত করে তুলছে। সময়ের জোরালো দাবি – গণমাধ্যমের সত্যনিষ্ট লেখনি, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, মনন-সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ তারুণ্যের অদম্য সক্ষমতার অবগাহনে এক আধুনিক যুগের ব্যাবর্তন সংস্কৃতির উৎসমূলে থাকবে এবং প্রতিটি সভ্য জাতিগোষ্ঠীতে সুশাসনের সংসর্গ প্রতিস্থাপন করবে।
নি:সন্দেহে বলা যায়; সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল উপাদানসমূহের বাণিজ্যিকীকরণের অপকৌশল সামাজিক অসঙ্গতিগুলোকে গাঢ় করে তুলছে। বিশেষ করে পণ্য উৎপাদন, বিক্রয় এবং বিতরণের পন্থা বিচিত্র এক অর্ন্তদন্ধের বিরোধ প্রক্রিয়াকে সুনিপুণভাবে সুদৃঢ় করছে। সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড রিছম্যান’র মতে; ঐতিহ্যিক, অন্যের মতামত নির্ভর বিবেক পরিচালিত আদর্শের ভিত্তিতে যে মনোজগৎ তৈরি হয় তা গণমাধ্যমের প্রচারিত বিজ্ঞাপন, জনমত তৈরি বা ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ইতি পরিবর্তনের অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত এবং অস্থিতিশীল, অবাঞ্ছিত, অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে দুর্দৈব অনৈতিক কালধারা প্রণিহিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে চার্লস ডিকেন্সের ভাষায়, একদিকে বিশ্ব সৌভাগ্যদের সর্বোত্তম এবং অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক ভাগ্যবিরূপ জনগোষ্ঠীর বর্বরতম রূপায়ন। তথ্য প্রবাহের কথিত বিশ্বায়নে দ্রুত পরিবর্তনশীল সৃজন ও মননশীলতার ক্ষেত্রগুলোও সামজিক ও সাংস্কৃতির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়। সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির বিরূপ প্রভাবে বস্তগত সংস্কৃতির অগ্রসরমানতা অবস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান তথা শিক্ষা-জ্ঞান-ভাষা-আইনসহ যাবতীয় মানবসম্পদ উৎপাদনে মানবীয় উপকরণের অন্তরায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পিছিয়ে থাকে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ-ধার্মিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা-মানবিকতা-দেশপ্রেম ইত্যকার অমূল্য বাহনগুলো।
প্রাসঙ্গিকতায় দৈনিক আজাদীর কলেবর নানা অনুষঙ্গে শুধু রঙ্গীন স্বপ্নে স্বাপ্নিক হিসেবে আবির্ভূত হয় নি; পক্ষান্তরে বস্তু-সত্য-ন্যায়নিষ্ঠ সংবাদিকতার পরিগ্রহে বহু খ্যাতিমান সংবাদকর্মী সৃজন করতে সক্ষম হয়েছে। পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক জাতির বিবেক খ্যাত অন্যতম অভিভাবক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এই পত্রিকারই অভিনব ফসল। বর্তমান সম্পাদক আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব জনাব এম. এ. মালেকের নেতৃত্বে এবং অত্যন্ত উঁচুমার্গের কবি-সাহিত্যিক-শিশু সাহিত্যিক-লেখক-লেখিকার অপূর্ব সম্মিলনে নেপথ্যে থাকা কুশীলবদের অকৃত্রিম নিষ্ঠা-আন্তরিকতা-পরিশ্রম দৈনিক আজাদীকে অত্যন্ত উঁচুমাত্রিকতায় মর্যাদাসীন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পত্রিকার উৎসস্থল কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে একুশকে কেন্দ্র করে কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কবিতা প্রকাশ, ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার অবিরাম প্রচার, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর জেলমুক্তিসহ দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনমত গঠন ও যৌক্তিক পরিবর্তনে দৈনিক আজাদীর অব্যাহত অবদান স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের যুগান্তকারী সমাপ্তি ও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ঐতিহাসিক দিবসে দেশে কোন পত্রিকা প্রকাশ না পেলেও ঐদিনই দৈনিক আজাদীর প্রকাশ-বিতরণ ও নিতান্তই সর্বনিম্ন মূল্যে বিক্রয় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মধ্যে প্রথম অবস্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় – এর চেয়ে প্রসংশনীয় অর্জন পত্রিকার জন্য আর কি হতে পারে!
স্বল্পপরিসরে দৈনিক আজাদীর বর্ণাঢ্য কীর্তিগাথার গ্রন্থন দু:সাধ্য ব্যাপার বটে। তবুও বর্ষপূর্তির এই দিনে পুরনো কিছু বিষয়কে স্মরণ করে দৈনিক আজাদীর প্রতি আপামর জনসাধারণের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-অভিনন্দন বার্তায় সুবাসিত করা না হলে কোন এক দিন ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। পত্রিকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠাতা পরম শ্রদ্ধেয় ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক-বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন সহচর প্রাক্তন সাংসদ ও পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, নির্যাতিত ম্যানেজার দবির উদ্দিন, প্রকাশকাল থেকে আজাদী পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়াত কলমযোদ্ধা, সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী-হকারসহ সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার কাছে তাঁদের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি। সমকালীন পাঠক-লেখক-কলামিষ্টসহ শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের প্রতিও পত্রিকার জন্মদিনে অজস্র অভিনন্দন। সম্ভবত: বরেণ্য কবি সিকান্দার আবু জাফর রচিত ‘ক্লান্ত প্রহর গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এল সন্ধ্যা, কার পথ চেয়ে নিশি জেগে রয় রাতের রজনী গন্ধা।’ চরণগুলো অনুসরণে প্রতিদিন রাতজাগা প্রস্ফুটিত রজনীগন্ধার মতো আজাদীর সৌন্দর্য-সৌকর্য অনুধাবনে চট্টগ্রামবাসী অবিরাম জাগরুক থাকবেই – এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।