অম্লমধুর ঝাল ও তিক্ততার জল- ২
স্বস্তি পেলাম বড়ই। কারণ ঐ যে আগেই বলেছি লম্বা সময় ধরে নিজের কর্পোরেট চাকরামির কারণে রক্তে ঢুকে যাওয়া পরিষ্কার রূপরেখা তৈরি যে করতে পারলাম এখন, এ রাতের ডিনারের জন্যেও সেই সফলতায়। কিন্তু কথা হচ্ছে দীপ্র এখনো রেডি হয়ে ফিরে আসেনি ঐ রুম থেকে। এরই মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আগেই আমাদের চা বিস্কিট খাওয়া পর্ব শেষ হয়েছে। ও এলেই বেরুতে পারি সাথে সাথেই। একটু আগেভাগে বের হয়ে, আগে ফিরতে পারলে, বিছানায় আগে যেতে পারলে যদি ভাল একটা ঘুম দিতে পারি ভাগ্যগুণে, তবে আগামীকালকের মহাপ্রাচির অভিযানের জন্য, পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে শরীর।
এই ভেবে ঐ রুমে গিয়ে এক্ষুনি বড়পুত্রকে তাড়াতাড়ি তৈরি হবার জন্য তাড়া দেবার জন্য উঠবো উঠবো করতেই মিহি সুরে দরজার কাছ থেকে ডোর বেল বেজে উঠতেই, বুঝলাম তার আর দরকার নেই। দরজা খোলার জন্য সামনের দিকে এগুতেই পিছু নিল হেলেনও।
দরজা খুলতেই দেখি এক্কেবারে ধড়াচূড়া পরে দীপ্র বাইরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি। আমাকে দেখেই বলল, ‘চল বাবা যাই আমরা’।
ততোক্ষণে পেছন থেকে হেলেন আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরুতে বেরুতে বলল, ‘তোরা একটু অপেক্ষা কর দাদা। আমি একটু আমার মাথার টুপি, মাফলার আরেকটা সুয়েটার গায়ে দিয়ে আসি। রাত তো হয়ে গেছে এখন তো ঠাণ্ডা বেড়েছে নিশ্চয় আরো’।
তীব্র উষ্মা ঝড়ে পড়লো দীপ্র গলা থেকে তাতে! ফুপ্পির কারণে এ মুহূর্তে আমাদের বাইরে যাওয়ার গতি কিছুটা রুদ্ধ হওয়ার কারণে। অবশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারছি এ হলো একটু আগে ঐ রুমের ফুপ্পি ভাইপো দ্বৈরথের জেরও।
কিন্তু মোটেও সুবিধা হলো না তাতে ওর। একদিকে যেহেতু হেলেন মোটেও গায়ে মাখেনি ব্যাপারটা, যাতে তার আরো রেগে যাওয়ার কথা, এবং গিয়েছেও সে। কিন্তু তা ঝাড়ার সুযোগ মোটেও পেল না ও। যেহেতু এরই মধ্যে জারি হয়েছে মায়ের সমন ‘দীপ্র এদিকে আসো? দেখি তুমি জামাকাপড় পড়েছ কি না ঠিক মতো, আর হাতে পায়ে মুখে লোশন মেখেছ কি’?
মায়ের এই অনিবার্য সমনের জবাবে মুখ না খুলে মাথা, কাঁধ, শরীর ঝাঁকিয়ে আর দেহভঙ্গিতে তার যে সব কিছু ঠিকঠাক আছে তা আমাকে নিশ্চিত করার সাথে সাথে, নিজের তুমুল অসহায়ত্ব প্রকাশ করে, আমার সাহায্যের আশায় অসহায় ভাবে তাকাতেই মূকাভিনয়ে বোঝালাম অবস্থা গরম করা যাবে না। ওরই যখন শব্দ করার সাহস নেই, সেখানে আমি তো কোন ছার। তারচে দ্রুত মায়ের কাছে গিয়ে নিজেকে সমর্পণ করো পুত্র। সেটাই নিরাপদ। মনে মনে বলছি বাবা, তুমি যা টের পাচ্ছ এখন কিম্বা জন্মের পর থেকে না হলেও বুঝতে শেখার পর থেকে, আমি তো তা টের পেয়েছি তোমার জন্মেরও বহুআগে যখন পড়েছিলাম সাতপাঁকে বাঁধা দু’জনে। সেই থেকেই তো ডুবে আছি দু’জনে শুধু অম্লমধুরই নয় ঝাল ও তিক্ততার জলেও। যে জলে ডুবলে জীবন হয় যাকে ইদানীং বলা হয় প্যারাময়। না ডুবলে চারিদিকে চলে অবিরল নানান ফিসফাস, ফুসফাস থেকে শুরু নানান স্বরের আর সুরের কলরব। পড়তে হয় নানান ঝড় ঝঞ্ঝাটে।
বড়ই বুদ্ধিমান ছেলে আমার! ইশারাতে বুঝে গেছে, বলেছি যা দেহ ভাষায় আর মনে মনে। তারপরও পুত্র হিসাবে তার যে কিছু শৌর্যবীর্য আছে, সেটির কারণে মুখ না খুলেও মোটা কার্পেট মোড়া হোটেলের মেঝেতেও ধুপধাপ শব্দ তুলে মায়ের এই সমনের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে জানাতে এগিয়ে গেল রুমের ভেতরে।
‘এইতো, এইতো দেখছি, লোশন তো মাখোনি ঠিক মতো ! এই যে হাতে, মুখে দেখতে পাচ্ছি এখনো লোশনের সাদা রং দেখা যাচ্ছে। খোল খোল জ্যাকেট, আর মাথার টুপি। এতো বড় হয়েছ এখনো ঠিক মতো লোশনও মাখতে শিখোনি। বেড়াতে এসে যে একটু আরাম করবো তারও জো নেই। পায়েও তো দেখছি একই অবস্থা’ !
সোফায় হেলান দিয়ে মা’পুত্রের লোশন দ্বৈরথ দেখতে দেখতে ভাবছি, হায়রে মাতৃস্নেহ ! আমাদের সময়ে আমাদের মায়েরা অবশ্য এরকম নিরঙ্কুশ স্নেহের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন কদাচিৎ। একদিকে তাঁদের ঘরে ছিল সন্তানদের সংখ্যাধিক্য, অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন দেশের ভঙুর অর্থনীতির কারণে ঘরে ঘরেই ছিল নানান টানা পোড়েন, যার মধ্যে হাবুডুবু খেতে হতো বাংলার মায়েদের তখন অষ্টপ্রহর। অতএব কোনো একটি সন্তানের প্রতি এরকম, নিরঙ্কুশ মনোযোগ দেওয়া তো সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে। তারপরও বহুকাল পর দেশ ছেড়ে বহুদূরের দেশে এসে এ মুহূর্তে পেলাম অনেক আগে গত হওয়া আম্মার স্নেহের উষ্ণতা হঠাৎ। মনে হল এইমাত্র পাওয়া এই উষ্ণতাটুকু গায়ে মেখে নির্দ্বিধায় হাঁটতে পারবো এখন বেইজিঙয়ের তুমুল হিমে ! এমনকি খুব বেশি গরম কাপড় গায়ে না থাকলেও, কুছ পরোয়া নেই তাতে!
দরজার দিক থেকে এসময় মিহিস্বরের বেল বাইরে হেলেনের উপস্থিতি ঘোষণা করতেই, উঠে গিয়ে দরজা খুলে ওকে ঘরে ঢোকার ইশারা করে, সোফায় বসে ফের মাতাপুত্রের লোশন দ্বৈরথ দেখছি। হ্যাঁ ব্যাপারটাকে দ্বৈরথই বলছি। কারণ আগেই তো বলেছি পুত্রসুলভ শৌর্যের কারণে দীপ্র ক্রমাগত নিঃশব্দে মায়ের স্নেহের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে যাচ্ছে গা হাত পা মুচড়ে। যার কারণে এরই মধ্যে দু চারটা চাপড়ও জুটেছে ওরা কপালে।
তবে কপাল ভাল এরই মধ্যে দীপ্রর শরীরে লাজুর লোশনাভিযানের সমাপ্তি ঘটেছে। ব্যস্ত ও এখন পুত্রকে পোশাক ঠিকঠাক মতো পরানোর কাজে। গলে অনতিবিলম্বে বাইরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করার মানসে সোফা ছেড়ে গাত্রোত্থান করতেই
‘বাবা, আমিও যাবো’। বলেই অভ্র কার্টুন দেখা বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাইরে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। ‘এই ছেলে তুমি না বলেছিলে তখন, ‘যাবে না তুমি? এখন আবার বাইরে যাবে বলে আমাদের দেরী করিয়ে দিচ্ছ কেন’? বলতে বলতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিছানার অন্য প্রান্তের দিকে রওয়ানা করতেই, মাঝ পথে থামালাম দীপ্রকে।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।