মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু

সৌভিক চৌধুরী | রবিবার , ১৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি জাতি নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। নিজস্ব গৌরব এবং মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল এ অঞ্চলের জনগণ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর শাসনে এ দেশের জনগণ পরাধীনতার এক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। নানান শোষণ, বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষের জীবনকে পেছনে ফেলে দেয়। এ সময় থেকেই বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়। এই আন্দোলনে শরিক হন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ভেতরে মূলত এমন এক জাগরণ তৈরি হয় যে তৎকালীন পরিস্থিতি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো গতিশীল করে তোলে। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর দেশপ্রেম মুক্তিকামী মানুষের সহযাত্রী হওয়ার বাসনায় প্রবল হতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে আরো বেগবান করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এগিয়ে যান। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে অধিকার আদায়ে বাংলার জনগণের প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সময়ে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করার ঘটনা নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে।

১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও উদাসীনতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতারা তাসখন্দ উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপনের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু এতে ৬ দফা পেশ করেন, যেখানে মূল দাবি ছিল পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিনত করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। এই দাবী উদ্যোক্তারা প্রত্যাখ্যান করেন এবং শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দমে যাননি, বরং দেশে ফিরে এসে ৬ দফার পক্ষে জনসমর্থনের জন্য ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন এবং বিভিন্ন সময়ে বন্দী হন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তাঁর গ্রেফতার এবং নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে ৭ জুন ১৯৬৬ দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। পাকিস্তান সরকারের দমনপীড়ন উপেক্ষা করে বাংলার মানুষ ৬ দফার প্রতি সমর্থন জানান। ৭ জুন বিনা উস্কানীতে আন্দোলনরত জনতার উপর গুলি চালানো হয় এবং এতে মনু মিয়া সহ ১১ জন নিহত হন। ৭ জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘১২ টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে, হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তাঁরা ৬ দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি কৃষকদের বাঁচার দাবি তারা চায়, যার প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে দিয়েই গেল’।

স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে যে আন্দোলন তখন গড়ে উঠেছিলো তা দমনের বিচিত্র কৌশল নিয়েছিল সরকার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই এবং এক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এরই মাঝে পাকিস্তান সরকারের নতুন চক্রান্ত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। এ মামলার মূল অভিযোগ ছিল আসামীরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ৬ দফা এবং ১১ দফার দাবীতে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে যে জাগরণ সৃষ্টি হয় তা সামাল দেয়ার মত অবস্থা সরকারের ছিল না। কারণ অভ্যুত্থান দমন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আসাদুজ্জামান। আর এরই প্রেক্ষিতে জনতার আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় এবং মামলা প্রত্যাহার করে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রীতি এমনই ছিল যে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ববাংলার নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ’। তাঁর এ ঘোষণার একটিই লক্ষ্য ছিল, শোষণ, নিপীড়নের অবসান করে দেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু এটি যে খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়, তা তিনি জানতেন।

১৯৬৯ সালে ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন, কিন্তু তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে নীরব থাকেন। পূর্ববাংলার প্রতি শাসকশ্রেণির অবহেলার সঙ্গে নির্মম শোষণের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচনী প্রচারণার সময় একটি পোস্টার পাকিস্তানী শাসনের অধীনে বাঙালির দুর্গতি, তাদের শোষণ ও বঞ্চনার একটি চিত্র তুলে ধরেছিলো। এই পোস্টারটি আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন আরও নিশ্চিত করে তোলে। পোস্টারটি ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ বঙ্গবন্ধু এই সাধারণ নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে এতে বিজয়ের প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেন, কারণ পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্যে এর বিকল্প ছিল না। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ঐতিহাসিক ৬ দফা এবং ১১ দফার ভিত্তিতে প্রণয়ন করার কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। কিন্তু সহযোগিতা তো দূরের কথা নিপীড়নের মাত্রাই বাড়িয়ে দিয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীরা। ১ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় সমগ্র বাংলা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হরতালের ডাক দেন। পরবর্তীতে তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বৈঠকের আয়োজন করে কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করে ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স জনসভায় উপস্থিত হন।

বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন যখন তিনি দেখলেন পাকিস্তানি শাসক সম্প্রদায় সেই সময় কথা না রাখার অভিপ্রায়ে দেশকে একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জনতার ইচ্ছানুযায়ী ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দেননি ঠিকই কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে। কারণ তিনি জানতেন, স্বাধীনতার ঘোষণা সেদিনই দিলে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে এবং বিদেশীরা বিরূপ ধারনা পোষণ করবে। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ৫২, ৫৪, ৫৮, ৬৬ এবং ৬৯ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের ইতিহাস উল্লেখ করে বাংলাকে মুক্ত করার অদম্য বাসনা রূপায়িত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাঁর ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা শত বছরের সমস্ত নিপীড়ন আর দুর্দশাগ্রস্ত বাংলার মুক্তির আহ্‌বান। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দৃঢ় অঙ্গীকার। হৃদয়ে মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার চেতনাকে বঙ্গবন্ধু ধারণ করেছিলেন বলেই ৭ মার্চে তাঁর অগ্নিঝরা ভাষণের সুকঠিন প্রকাশ। তাঁর সেই মুক্তির ডাক সকল অন্যায় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ডাক। রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করার আহ্‌বান তিনি জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায়। তিনি ছিলেন শোষিতের পক্ষে, দর্শন ছিল চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার সংকল্প, তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি কাটিয়েছিলেন কারাগারে। একজন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন বাংলার জনগণের মুক্তির দূত। বাঙালির সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, ১৫ আগস্ট এমন একজন দূরদর্শী, স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক এবং সাহসী একজন নেতাকে তারা হারিয়েছে। বঙ্গবন্ধু না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো কিনা সন্দেহ, সবচেয়ে বড় কথা বাংলার পতাকা, বাংলার মানচিত্র আর অর্থনৈতিক মুক্তি একই সাথে গাঁথা হতো না। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবতে গেলে বঙ্গবন্ধু অনিবার্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর