দেশ হতে দেশান্তরে

সন্ন্যাসী জুতো ও চণ্ডীপাঠ : ২

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

এ জুতোটি পায়ে গলে যাবার পর যেরকম বোধ হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, নাহ ৪১ না ৪২ নম্বর নিলেও চলবে। তবে এক পায়ে জুতো পরে তো পুরো ব্যাপারটি বোঝা হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না, তাই হাতের ইশারায় ঐ নম্বরের বাকি জুতোটিও আনতে বলতেই দ্রুত সে এই সেকশনের সামনের দিকে যে সেলফে রাখা আছে বাকি জুতোটি, সেদিকে চলে যেতেই, প্রথমবারের মতো এই পুরো সেকশনটিতে চোখ বোলালাম। উদ্দেশ্য এরা বেল্ট বিক্রি করে কি না তা দেখা। যদি থাকে বেল্ট এখানে তবে জুতোর সাথে ম্যাচিং রঙ্গয়ের বেল্টও কিনে নেব। কিন্তু নাহ পড়লো না চোখে কোনও বেল্ট এখানে।

ততক্ষণে দেখছি দু কন্যাই হাজির যার যার জুতো নিয়ে। জুতো নিয়ে ফিরে এসে এ সেকশনের কন্যা আমার পায়ের কাছে বসে ৪২ নম্বর জুতোর অন্য পাটিটি পায়ে গলাতে ব্যস্ত হাস্যময়ীর হাতে সে জুতো জোড়া তুলে দিয়ে ফের গিয়ে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে।

পর পর দু জোড়া জুতোই পায়ে দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করার পর পড়ে গেলাম ধন্দে, কারণ দু জোড়াই দেখছি লাগছে পায়ে। ৪১ নম্বরের জুতোটা একদম আঁটসাঁট মনে হলেও ৪২ নম্বরেরটাকেও খুব ঢিলেঢালা মনে হচ্ছে না। বরং ওটাও ঠিকই ফিট হয়েছে পায়ে এবং বেশ আরামও লাগছে তাতে। এখন নেব কোনটা? এরকম ঝামেলায় এই প্রথম না, জুতো কিনতে গিয়ে আগেও পড়েছি। এমনিতে নানাজনকে বলতে শুনেছি চামড়ার জুতো নতুন অবস্থায় যতোই আঁটসাঁট মনে হোক না কেন, কিছু দিন পায়ে দেবার পর তা খোলতাই ও আরামদায়ক হয়ে উঠে। সে কথা বিবেচনায় নিলে নেয়া উচিৎ আমার ৪১ নম্বরেরটাই। আর এ মুহূর্তের আরাম বিবেচনায় নিলে ভোট যায় ৪২ নম্বরের দিকে। কী যে করি? কাকে যে জিজ্ঞেস করি? এই হাস্যময়ীকে ঐ কথা জিজ্ঞেস করে তো কোনও লাভ নাই। এছাড়া এর আগেও এমতাবস্থায় যখনই কোন বিক্রয়কর্মিকে জিজ্ঞেস করেছি তাহলে কোনটা নেয়া উচিৎ আমার? সটান জবাব ছিল তাদের, ‘দ্যাটস আপ টু ইউ স্যার’

আরে দূর! এতো চিন্তা করে লাভ কী? ৪২ নম্বরেরটাই নিয়ে নাও। এখন তো আর নিজের জন্য কিনছ না এই জুতো, কিনছো আরকেজনের জন্য। সেক্ষেত্রে সামান্য একটু বড় জুতো নেয়াই ভাল। আঁটসাঁট জুতো নিলে যদি তার পায়ে না লাগে! জুতো সামান্য বড় হলে, মোটা মোজা বা সামান্য তুলো টুলো ঢুকিয়ে হলেও পড়া যায়। কিন্তু ছোট হলে তা ফেলে দেয়া বা কাউকে দিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।

বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, মনের দ্বিতীয়জন এই লম্বা বয়ানটি ঝাড়তেই, তা নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিলাম তার কথাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ৪২ নম্বরের যে জুতোটি পরলাম সেটি হলো ট্যান কালারের। মনে পড়ে অনেক আগে একবার ব্যাংকক থেকে, এই পিয়েখে কাঁদার এক স্ট্রাপের এক জোড়া ট্যান কালারের মংক স্যু কেনার পর, ঐ রঙ্গয়ের বেল্ট না থাকায় আর বহুদিন ঐ রঙ্গয়ের বেল্ট খুঁজে না পাওয়ায় অনেকদিন তা পরতে পারিনি। ওইরকম ঝুঁকি তো নেয়া যাবে না। কারণ এখানে তো কোনও বেল্ট নাই। আবার আগে যেমন নিজের জন্য ট্যান কালারের বেল্ট খুঁজে পেতে অনেক দিন লেগেছিল, সেরকম সময় তো হাতেও নাই এই বরবাবাজীর জন্য। সেক্ষেত্রে ৪১ নম্বরের জুতোটাই নেয়া ভাল। কারণ ঐটি ব্রাউন কালারের, যে রঙ্গয়ের বেল্ট মোটামুটি সহজেই পাওয়া যায়।

কিন্তু নাহ ভাষা বিভ্রাটের এই শহরে এই দুই সহজ বিকল্প বাদ দিয়ে কেন জানি চলে গেলাম তৃতীয় বিকল্পে। দু জোড়া জুতোই পাশাপাশি রেখে, হাতের ইশারার সাথে দেহভঙ্গীর মিশিয়ে সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে হাস্যময়ীকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমার চাই ৪২ নম্বরের বাদামি রঙ্গয়ের জুতো।

এখানকার ভাষাবিভ্রাটের দুর্লঙ্ঘ মহাপ্রাচীর অতিক্রম করে নিজের ইচ্ছা প্রকাশের আমার এই অদম্য প্রচেষ্টায়, বরাবরের মতো প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও অচিরেই মনে হল বোঝাতে পারলাম তা হাস্যময়ীকে ! কারণ দেখছি সে ফের চুং চাং চিং করে কী যেন বলল এখানকার আসল বিক্রয়কন্যাকে, যা শুনে সে রওয়ানা দিয়েছে ফের সেকশনের পেছনের দিকে যেখানে আছে জুতোর স্টোর। ভরসা পেলাম তাতে।

ব্যাপার হচ্ছে ছোটবেলায় আব্বার কাছে শেখ সাদির সেই বিখ্যাত পোশাক বিষয়ক গল্পটি শোনার পর পোশাক পরিচ্ছদ বিষয়ে একটা অবজ্ঞার ভাব জন্মালেও, কৈশোরে তারুণ্যে এসে ঠিকই ফ্যাশনেবল হওয়ার ঝোঁক চেপেছিল। যদিও তখনও সেটা খুব একটা গুরুত্ব পায়নি, কারণ পরেছি তো সে সময় সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ই। তবে পেশাগত জীবনে ঢোকার পর অচিরেই জেনে গিয়েছিলাম এ ব্যাপারটির বিশেষ গুরুত্ব। অনেকটা ঠেকে পড়েই সেই সময়ে শিখেছিলাম জুতোর সাথে বেল্টের রঙয়ের একটা সম্পর্ক আছে, ফ্যাশনের না হলেও স্টাইলের। সেই যে শিখেছি সেটা, সেই থেকে তা মানতেও চেষ্টা করছি তা আজো। যদিও জানি জীবনে এসবের আসলে ফুটো পয়সারও গুরুত্ব নেই। তারপরও এইরকম একটা গুরুত্বহীন ব্যাপারের কারণে, পেশাগত প্রতিযোগিতায় অহেতুক পিছিয়ে পড়াটাও মানতে পারিনি। ফলে মনে মনে যতোই এসবকে তুচ্ছ মনে করি না কেন, বাহ্যিকভাবে ঐ সব তুচ্ছ সুত্রকেও অগ্রাহ্য করি না। ব্যাপারটিকে দ্বিচারিতা বা হিপোক্রেসি মনে হয় নিজের কাছেই। কিন্তু কী যে করি? নিজের মতো কী আর সবকিছু করতে পারি সবসময়? ফলে নানান রকমের ভড়ং, দ্বিচারিতা আর হিপক্রেসি একবারের এই একটি জীবনকে তো রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে!

জুতো সেলাই করতে গিয়ে চণ্ডীপাঠ করার মতো জুতো কিনতে এসে এখানে বসে এসব নানান গভীর বিষয় ভাবতে ভাবতেই এসময় চোখে পড়লো আসছে পেছন থেকে এই সেকশনের বিক্রয়কন্যা একটি বাঙ নিয়ে, যা দেখে হাস্যময়ী তার সাথে চিং চাং চুং বাক্য বিনিময় করে, আমার দিকে তাকিয়ে যে দেহভঙ্গি করলো, তার অর্থ দাঁড়ালো -‘হ্যাঁ মিয়া অবশেষে পাওয়া গেছে তোমার প্রার্থিত বাদামি জুতো।’

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নযাত্রী পাঠাগার : বইমুখী সমাজের প্রত্যাশায়
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ