দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

হাত দিয়ে আধলা ইটের যে সাইজ দেখাল দীপ্র, হাসি পেল তাতে একদিকে যেমন, তেমনি মনে হল অভ্রর ছোড়া সেই বরফের টুকরা ছোট হলেও সোজাসুজি তা যদি দীপ্রর চোখে লাগতো, তাহলে তো আসলেই বিপদ হতো! বেশ বিরক্ত গলায় দুজনকেই বললাম যে, এটা কেমন খেলা তোমাদের? আমি তো জানতাম না, যে তোমাদের হাতে বরফ তুলে দিলে তোমরা, একজন আরেকজনকে তা ছুড়ে মারামারি শুরু করবে! এ কোন খেলা?

স্নো ফলের সময়তো এভাবেই বরফ ছুড়ে ছুড়ে খেলতে হয় বাবা। টিভিতে ইউটিউবে দেখেছি ইউরোপে আমেরিকায় বাচ্চারা স্নো ফলের সময় এভাবে স্নো বল বানিয়ে একজন আরেকজনকে ছোড়াছুড়ি খেলে। লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে স্নোয়ের উপর। স্নোম্যান, সান্তা ক্লজ বানায় স্নো দিয়ে। দেখো নি তুমি তা’?

ইউরোপ আমেরিকার মজার একটা খেলা, খেলার সুযোগ নিজেদের ভুলে এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই, ব্যাপারটা সামলানোর জন্য দুজনেই দ্রুত একজোট হড়বড় করে বলল কথাগুলো যৌথ স্বরে!

তা তো বুঝলাম। কিন্তু ওরা তো এরকম জমে শক্ত হয়ে যাওয়া বরফ ছোড়াছুড়ি করে না। ওরা যা নিয়ে খেলে তা হল পেঁজা পেঁজা মানে আকাশ থেকে নেমে আসা গুড়া গুড়া বরফ দিয়ে। ‘বুঝেছি, আমরা তা হলে একটা স্নোম্যান বানাই এখন’। মরিয়া গলার আকুল আবেদন এলো দীপ্রর কাছ থেকে, সাথে অভ্রর চেহারায় আর দেহভঙ্গিতেও দেখা গেল একই ব্যাকুলতা! যদিও জানি এরকম জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যাওয়া বরফ দিয়ে ওদের পক্ষে স্নোম্যান বানানো সম্ভব নয়, তারপরও তা আর না বলে, বললাম ঠিক আছে সেটাই করার চেষ্টা করো। কিন্তু খবরদার আর কোনো বরফ ছোড়াছুড়ি নয়।

ওদিকে এরই মধ্যে হেলেন আর লাজুও গাড়ি থেকে নেমে পড়লেও, হেলেনই শুধু রাস্তার এপাড়ে এসে ভাতুষ্পুত্রদের বরফ নিয়ে খেলা করার ছবি তুলতে শুরু করেছে অনবরত। অন্যদিকে লাজু রাস্তার ঐ পাশে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে পুত্রদ্বয়ের উদ্দেশ্যে

এই এই তোমার গ্লোভস খুলছো কেন? ওটা খুলো না, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এই দেখো জামাকাপড় ময়লা করো না’। এসব বলতে বলতে এসব অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আমার দায়িত্বজ্ঞানহীন বেখেয়ালিপনা ও পুত্রদের প্রতি এরকম অযৌক্তিক প্রশ্রয়ের মুণ্ডুপাত করতে থাকল। এদিকে দুই কান এক মুখ থাকার যে সূত্র আছে আমাদের প্রবাদে তা মনে পড়ায়, স্ত্রীমুখনিসৃত ঐসব অম্লগরল বাক্য এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করতে করতে এক্কেবারে মুখ বুঝে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, এলাকাটা একটু জরীপ করার মানসে। যদিও জানি না কোথায় নামলাম? কী নাম জায়গার? কিম্বা এখনো আরো কতোটা যেতে হবে সামনে ঐ মুতিয়ানু গ্রামসংলগ্ন মহাপ্রাচির পৌঁছানর জন্য, তাও জানি না। তা নেমেই যখন পড়লাম, একটু ঘুরে দেখতে অসুবিধা কি। এখানকার এ মাটিতে কখনো যে পা রাখবো তা তো ভুলেও ভাবিনি। একটু আগে লি খানকে জিজ্ঞেস করে তো উত্তর পেয়েছি শুধু ‘ওকে, ওকে’; যার মানে যা কি তার তো মাথা মুণ্ডু ও নির্ণয় করতে পারিনি এখনো।

ওহ হ্যাঁ, সময় তো দেখা যায়। সময় আন্দাজ করেও তো বোঝা যাবে এসেছি কতোটা দূর। অতএব পকেট থেকে হাতফোন বের করতেই সেটির পর্দায় জ্বল জ্বল করা সময় জানালো এক ঘণ্টা বিশ বাইশ মিনিট পার হয়ে গেছে এরইমধ্যে। যার মানে হলো মোটামুটি চলেই এসেছি কাছে। লি খাঁর ‘ওকে ওকে’ র মানে কী হল তাহলে, ‘চলেই এসেছি প্রায়’ কিম্বা ‘আর একটু সবুর করো ’?

যদিও হাতফোনটা বের করেছিলাম শুধুই সময় দেখার জন্য, কিন্তু নিজের পেশাগত কর্পোরেট অভ্যাসবশত এরই মধ্যে আঙ্গুল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফোনের পর্দায় লাগানো সংখ্যাতালা যার আসল নাম পাসওয়ার্ড তা দিতেই, পর্দায় থাকা ইমেইল নির্দেশক চিঠির খামটার উপরে ৩৭ লেখা সংখ্যাটি জানান দিল যে, কাল রাতে সর্বশেষ মেইল চেক করার পর এরই মধ্যে ৩৭ খানা চিঠি এসেছে, অধম বরাবর।

ছুটিতে আছি, অতএব বাধ্যবাধকতা নেই তেমন চিঠির দেখার বা জবাব দেবার এক্ষুণি। জরুরি কিছু হলে এরই মধ্যে ফোন পেতাম অফিস থেকে। তা যেহেতু পাইনি অতএব ঐসব আর এখন দেখবো না। রাতে ঘুমানোর আগে দেখবো, এই ভেবে পকেটে রেখে দিলাম হাতফোন ফের।

বেশ অনেকটাই হেঁটে এসেছি সামনের দিকে। টের পেলাম হিমের উপরে হিম তৈরি করা ঝির ঝির বাতাস গালে মুখে নাকে লাগতেই তীর তীর কাঁপছে মনে হল গাল। গাল ডলতে ডলতে ভাবছি, আচ্ছা এক সময় কি আকুতি নিয়েই বসে থাকতাম দিনের পর দিন, একটা চিঠির আশায়। যখনই এলাকায় সাইকেল চালিয়ে ব্যাগভর্তি চিঠি নিয়ে ডাকপিয়ন চাচার আগমন ঘটতো, মহা আনন্দিত হতাম। সে আনন্দের কারণ ছিল দ্বিবিধ। এক মনে মনে ভাবতাম আমার কোনো চিঠি এলো নাকি কোনো পত্রমিতার কাছ থেকে, কিম্বা আমার না হলেও ঘরে আব্বা বা আম্মার কাছে চিঠি এলো কি না? দ্বিতীয়ত নিজেদের ঘরে চিঠি না এলেও পাড়ায় অন্য কোনো ঘরের কারো কাছে চিঠি আসা মানে তো ডাকটিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল। আর যদি তা হয় বিদেশ থেকে আসা কোনো চিঠি তাহলে তো আর কথাই নেই! এখন এই ডিজিটাল টেকনলজির যুগ যোগাযোগের গতি এতোটাই বাড়িয়েছে যে, আসে চিঠি সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে। আসে তা প্রেরকের কাছ থেকে সরাসরি প্রাপকের কাছে। মাঝখানে পোস্ট অফিস বা ডাকপিয়নের বালাই নেই। আসলে হয়েছে যা, তা হলো পকেটে সারাক্ষণ গোটা পোস্টঅফিস ভরে নিয়েই তো ঘুরছি। প্রতিদিন পাওয়া ডজন ডজন ঐসব চিঠিতে নেই কোনো ডাকটিকিট, নেই কোনো আবেগও। ফলে চিঠি বিষয়ক যে সংস্কৃতি ছিল আমাদের, না শুধু আমাদেরই না, ছিল যা নানা দেশে দেশে সমাজে সমাজে সে সংস্কৃতিটি একদমই বদলে গেছে এরই মধ্যে।

শুধু চিঠির সংস্কৃতি কেন? এখনকার সার্বক্ষণিক তুমুল গতির যোগাযোগ নানান দেশের খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক থেকে শুরু করে জীবন যাপনের অনেক অভ্যাসগত সংস্কৃতিই তো বদলে দিয়েছে। এই যে একটু আগে পুত্রদের ছেড়ে আসলাম পেছনে বরফ দিয়ে স্নোম্যান বানানোর খেলা খেলার জন্য, এটাও তো একটা বিরাট সাংষ্কৃতিক পরিবর্তনই। মৌসুমি বায়ুর চাদরে মোড়া তুমুল বৃষ্টিস্নাত বাংলার বাচ্চারা তো খেলবে বৃষ্টির জলে নানান খেলা, যেমন খেলেছি আমি। বানাবে হাতি ঘোড়া থেকে শুরু করে নানান জন্তু, জানোয়ার, ফুলপাখি কাদামাটি দিয়ে, যেমনি করেছি আমরা। অথচ পুত্ররা আমার কখনোই তা করেনি, বা করতে চায়ও নি। অবশ্য চাইলেও যে আমরা তা মনজুর করতাম, তাও তো না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, সেই ইচ্ছাটিই তো জাগেনি তাদের মনে অথচ ভিনদেশে অচেনা জলবায়ুর কারণে ওখানকার বাচ্চারা যেসব খেলার জন্ম দিয়েছে, সেটি নিয়ে তো ওদের আগ্রহের কমতি নেই?

আচ্ছা ঐ যে রাস্তার ওইপাশে বড় গাছটা আছে, সেটির আড়ালে সেই গাছেরই বেশ মোটা কাণ্ডে হেলান দিয়ে কেউ একজন যে দাঁড়িয়ে আছে, তার পোশাকের আভাসে তো মনে হচ্ছে যেই হোক সে, চিনি মনে হচ্ছে তাঁকে। ঐদিকে চোখ রেখে দু পা আরো এগুতেই দেখা গেল, আসলেই চিনি তারে! উনি আর কেউ নন, উনি হলেন আমাদের লি খাঁ। কানে ফোন ধরে আছে সে। সারাক্ষণই তার ভাবলেশহীন প্রস্তরবৎ চেহারা দেখে অভ্যস্ত হলেও, এখন তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে চুং চাং চিং চাং চুয়া এসবের তুবড়ি ফুটছে তার মুখে। কার সাথে কথা বলছে সে? নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকা বউয়ের কাছে হাজিরা দিচ্ছে মনে হয় ফোনে। থাক এর মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি তো না স্যুপের বাটিতে হাড্ডি না হওয়াই ভাল।

লি খাঁ আর আমরা ছাড়া রাস্তার আশেপাশে আর কোনো লোক দেখছি না। এরই মধ্যে খান দুয়েক গাড়িকে দেখেছি আমাদের পেরিয়ে চলে যেতে সামনে। রাস্তার দু ধারে থাকা গাছের গোড়ায় নানান জায়গাতেই বরফ জমে থাকতে দেখছি। বিশেষত রাস্তার এই পাশটার অদূরে যে উঁচু টিলা না বলা ভাল মাটির ঢিবি গুলো আছে ওখানটাতেই বরফ দেখা যাচ্ছে বেশি। তবে গাছগুলোর মাথায় আর শরীরে সবুজের কমতি নেই। আচ্ছা এমন কেন? বরফ হলে তো গোটা এলাকাতেই তা থাকার কথা। এরকম খাবলা খাবলা ভাবে নানান জায়গায় ওগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কেন?

ভাবতে ভাবতে হাঁটা থামিয়ে আশপাশটা ফের ভাল করে জরীপ করার জন্য পেছন ফিরে বা দিকে তাকাতেই, লি খাঁ হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করতেই, বোঝা গেল না চাইলেও আসলেই আমি তার স্যুপ বাটিতে হাড্ডিই হয়ে গেছি।

তড়িঘড়ি করে আমারই দিকে তার এগিয়ে আসা দেখে মনে হল, সে হয়তো ভাবছি আমি তাকে খুঁজতে বেড়িয়েছি। নাহ তাঁকে আর টেনশনে রেখে লাভ নেই। আমারও আর সামনে গিয়ে কাজ নেই। রাস্তা পার হয়ে লি খাঁর দিকে এগুতে এগুতে সামনে তাকাতেই রাস্তার পাশে দাঁড়ানো আমাদের গাড়িটা স্পষ্ট দেখতে পেলেও পরিবারের কাউকে দেখতে না পেয়ে, ভাবছি গেল কোথায় ওরা। এদিক ততোক্ষণে লি খাঁ আমাকে তার দিকে এগুতে দেখে, হাতের ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে উল্টা ঘুরে গাড়ির দিকে এগুনো শুরু করতেই বুঝলাম, ঠিকই ধরেছিলাম একটু আগে। আসলেই সে ভেবেছে আমি বুঝি তাঁকে খুঁজছি আমাদের যাত্রা ফের শুরু করার জন্য। হাত নাড়িয়ে আমাকে আশ্বস্ত করে তাই সে গাড়ির দিকেই ফিরে যাচ্ছে। আচ্ছা, ঐ যে হলুদ বিল্ডিংটা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার এ পাশে সেটা তো নজরে পড়েনি তখন, রাস্তার ওপাশ দিয়ে হাঁটছিলাম যখন! কী ওটা। বন্ধ সব দরজা জানালা আর সামনের টানা বারান্দা দেখে মনে হচ্ছে, কারো বাড়ি নয় নিশ্চয় ওটা। চেহারা সুরতেও নেই তার চাইনিজ ভাব। এটা কি তাহলে এই এলাকার কোনো ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস টফিস নাকি? আমাদের দেশের ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস তো থাকে গ্রামের বাজারেই দেখেছি সাধারণত। এখানে এরকম বিরান জায়গায় এটা কী তবে? আচ্ছা এখানে কি ইউনিয়ন আছে? নিশ্চয় আছে, কিন্তু নাম ভিন্ন অবশ্যই। ওহ মনে পড়েছে! এখানে তো কমিউন বানিয়েছিল মাও একসময়। এটা কি তবে সেই কমিউন অফিস? আচ্ছা কমিউন সিস্টেম কি এখনো আছে এখানে? মনের ভেতরের দুজনের এরকম প্রশ্নোত্তর চলছে যখন দ্রুত তার সাথে তাল মিলিয়ে পা ও চালিয়েছি জোরেই, লি খাঁ কে অনুসরণ সামনে গাড়ির দিকে ফেরার জন্য। চোখ খুঁজছে এখনো ওদের কে। এটা তো কোন গলি ঘুপচি সংগকুল জায়গা নয় যে কেউ হারিয়ে যাবে। আবার জনবিরল এ জায়গায় কোনো চোর বদমাশ বা বাজে লোকের পাল্লায় পড়ার বিপদও নেই, তাও কেন যেন অজানা আশংকায় বুক ঢিপ ঢিপ করছে ওদেরকে দেখতে না পেয়ে।

এরই মধ্যে লি খাঁ পৌঁছে গেছে গাড়ির কাছে। আর সাথে সাথেই গাড়ির পেছন দিকের আড়াল থেকে সবাই এগিয়ে এলো লি খাঁর দিকে। এসেই দেখছি দলের দুই নারী সদস্যই হাত পা নেড়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে লি খাঁ কে। জানি ওদের এ চেষ্টায় কোনো কাজ হবে না। অতএব বাড়ালাম গতি আরো নিজ পায়ের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বাসে বাঁচে বন্ধুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবক নূর আহমদ চেয়ারম্যান