দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

মোঃ ছাকী হোসেন | মঙ্গলবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে চক্ষু বহু বড় এক নিয়ামত। একজন সুস্থ্য মানুষ যত বছরই বাচুক দু’টি চক্ষু দিয়ে এ পৃথিবীর অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ, যান্ত্রিক সম্পদ, খাওয়া বা পরার দ্রব্যাদী দেখে থাকে। উপভোগ করে থাকে। কিন্তু অনেক মানুষ আছে যাদের একটি অথবা দু’টি চক্ষু নাই। এ ধরণীর অনেক অনেক বন্তু, প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম চোখে দেখার সৌভাগ্য হয় না। কেহ কেহ আছেন জন্মগত ভাবে দু’টি ভাল চক্ষু নিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে জীবণদশায় কোন এক সময়ে কোন এক দুর্ঘটনায় একটি চক্ষু বা দু’টি চক্ষু হারিয়েছেন। এতদিন যে মনোরম দৃশ্য, সামাজিক যোগাযোগ, কাজ-কর্ম অনায়াসে করতে পেরেছে আজ তা আর হচ্ছে না। এ এক নিষ্ঠুর চিত্র। সংসারের অন্যান্য জনেরাও মানসিক দূর্দশায় পতিত হন।
এতো গেল অন্ধজনের কথা বা এক চোখ ওয়ালা ব্যক্তির কথা। সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় চোখ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন নাই এমন লোক কম আছেন। বিগত কয়েক বছর দেখা গেছে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে অভিভাবকরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। অর্থাৎ অল্প বয়সে চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। পিছনের বিভিন্ন রকম কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ শিশু, কিশোরদের খাওয়া, দাওয়া। এটা খাবো না, ওটা খাবো না, ইত্যাদি অজুহাতে চোখের যে পুষ্টি দরকার তা আর খাওয়া হয় না। এরই ফলশ্রুতিতে চোখের এমন দশা। এখন আরোও মারাত্মক যে বিষয় গবেষণায় উঠে এসেছে তা হচ্ছে টেলিভিশন। তা থেকে ল্যাপটপ এখন মোবাইল ফোন। আসক্তি জুড়ে বসেছে শিশু, কিশোরদের মনে ও সময়ে। এতে কতিপয় মা-বাবা, অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে পড়েন এগুলি ব্যবহারের অনুমতিদিতে। আবার অনেকে স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা থেকেই স্বেচ্ছায় বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি মোবাইল ফোন। সেটি আইফোন হোক বা এন্ড্রোয়েড হোক।
গ্রামের চিত্র অনেক সময় ভিন্ন হয়ে যায়। যেমন শিশু, কিশোররা ঝগড়া-ঝাটি করে বা খেলাচ্ছলে বাঁশের চিকন কনচি দিয়ে অনেক সময় চোখে আঘাত করে এতে চোখের বাহিরে অথবা ভেতরে আঘাতের ক্ষত হয়ে থাকে। কৃষকদের বেলায় অনেক সময় ধান কাটতে গিয়ে ধানের শীষের আঘাতে চোখের ক্ষতি হয়ে যায়। চোখের বাহিরের অংশের বা ভিতরের সাদা অংশে বা কর্ণিয়ায় আঘাত লেগে থাকে। সমাজ দর্শনে দেখা যায় অনেক সময় পাখি শিকারী বা বক পাখি শিকার করতে গিয়ে বকের টুকরে চোখে আঘাত লাগে। এমন এমন অনেক বিষয় রয়েগেছে চোখের অসুখের বা চক্ষুরোগের কারণ সমূহের পিছনে। তবে বয়সের কারণে চোখে ছানি পড়ার ঘটনা অহরহ হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় চল্লিশ উর্ধ্ব একজন ব্যক্তির চোখের জ্যোতি কিছুটা কমতে থাকে এতে দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হওয়ায় চশমা ব্যবহার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। চাকরীজীবিদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশী দেখা যায়। বিশেষ করে কোন কিছু লিখতে বা পড়তে হলে অসুবিধা উপলব্ধি থেকেই চশমা ব্যবহারের দিকে মানুষ ঝুকে পড়ে। এ সব কিছুই মানুষ ও চোখের ব্যবহারিক দিক থেকে উদ্ভুদ্ধ পরিস্থিতি।
এবার আসা যাক এসব কিছুর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রতিকার। বাংলাদেশে আশির দশকের গোড়ার দিকে চক্ষু রোগের চিকিৎসার জন্য তেমন বড় বড় হাসপাতাল, ক্লিনিক, চক্ষু সেবা কেন্দ্র ইত্যাদি ছিল না। এমন কি চক্ষু রোগ নির্ণয়ের অনেক যন্ত্রপাতিও ছিল না। বর্তমানে আধুনিক তথা ডিজিটাল যুগে বড় বড় শহরে চক্ষু হাসপাতাল, ক্লিনিক, চক্ষু সেবা কেন্ত্র নেই এমনটি পাওয়া কঠিন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী যে চক্ষু রোগের বৃদ্ধির সাথে সাথে চক্ষু সেবার জন্য চক্ষু ডাক্তারও সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
গ্রামে গঞ্জে চক্ষু রোগীর সংখ্যা বেশী। এটার কারণ ইতিমধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে চিকিৎসা পেতে বেশ বিড়ম্বনায় তাদেরকে পড়তে হয়। কোন কোন গ্রামে বা উপজেলা শহরে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। হাতে গোনা কয়েকটি উপজেলা শহরে হয়ত পাওয়া যাবে, সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘন্টার জন্য অথবা দু’দিন। এতে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকের বা তাঁর সাহায্যকারীর। আবার সব রোগী যে ভাল হচ্ছে তা হলপ করে বলা যায় না। আবার কিছু কিছু জটিল রোগীকে প্রেরণ করা হয় বড় কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। তবে গড়পড়তায় দেখা যায় দৃষ্টিশক্তি শুদ্ধ করার (Vision Correction বা Refraction) করার রোগীই বেশী। বয়স্ক রোগীর মধ্যে ছানি পড়েছে এমন রোগীর সংখ্যা বেশী। কর্ণিয়ার আঘাত, আস্তে আস্তে দৃষ্টি কমে যাওয়া বা পূর্বে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছানি পড়া ইত্যাদি রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে যে সকল রোগীর ডায়াবেটিস (বহুমূত্র রোগ) আছে তাদের চোখের রোগ অনেকটা স্বাভাবিক যা পরীক্ষান্তে নিশ্চিত হওয়া যায়। বর্তমানে কম হলেও পূর্বে গ্রামে চোখের রোগীরা কবিরাজি চিকিৎসায় শামুকের পানি, তুলসী পাতার রস, সাপুড়ে দ্বারা ঝাড়া ইত্যাদি প্রচলন ছিল।
আমার ছাত্র জীবন এবং চাকরী জীবন মিলে প্রায় ৪৩ বছর চট্টগ্রামে বসবাস। চট্টগ্রামবাসীকে আমি বলি-আমি চট্টগ্রামের গ্রীণ কার্ড হোল্ডার। সে সুবাধে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক, সামাজিক, ধর্মীয় তথা শহুরে পরিবেশের একটা অভিজ্ঞতা আছে বলেই দাবী করি। এরই মধ্যে আমি মনে করি বৃহত্তর চট্টগ্রামের গ্রাম ও শহরের মানুষসহ কাছাকাছি নোয়াখালী ও কুমিল্লার মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম শহরের ফয়েজলেকের পাশে “চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” আবির্ভাব হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির সাথে যিনি জড়িত আছেন তিনি দেশ বিদেশের বহু সংখ্যক পুরষ্কার প্রাপ্ত, খ্যাতনামা চক্ষু বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সমাজকর্মী জনাব রবিউল হোসেন। তিনি চট্টগ্রামেরই সন্তান। যিনি এ প্রতিষ্ঠানটিকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, ভারত ইত্যাদি দেশে পরিচিতি দিয়েছেন। এখানে চক্ষু রোগীকে অন্যন্য সেবা, ব্যতিক্রমী সেবা, সততাজড়িত সেবা, শৃঙ্খলামূলক সেবা, শিক্ষাব্রত সেবা দেয়া হয়ে থাকে এবং অনেক বছর থেকে দেয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে চক্ষু রোগী চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, নোয়াখালী, কুমিল্লা এমনকি সুদূর সিলেট থেকেও এ হাসপাতালে ভিড় জমাচ্ছে সুশৃঙ্খল লাইনের মাধ্যমে যার তদারকীতে আছেন এ হাসপাতালেরই কর্মীবাহিনীতে নিবেদিত কয়েকজন চক্ষুসেবা দানকারী। রোগীদের শৃঙ্খলার বিষয়টি তদারকীর জন্য আবার নিয়োজিত আছে ব্যবস্থাপনার কতিপয় কর্মকর্তা। রোগী দূরদুরান্ত থেকে এসে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিলে আছে সুবিন্যাস্ত, পরিষ্কার ওয়াসরুম। একটি দু’টি নয় কয়েকটি। নারী-পুরুষ আলাদা। নাস্তা-পানি গ্রহণের জন্য আছে সুচারুরূপে পরিচালিত ক্যান্টিন। রোগী বা রোগীর সহযোগীর পছন্দ অনুযায়ী আছে খাদ্য। প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য বিবেচনা যোগ্য। সর্বোপরি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যসম্মত।
হাসপাতালে রোগী বা রোগীর সহযোগীরা আসার পর যে শৃঙ্খলার মধ্যে পড়েন তাতে সিংহভাগ রোগী খুশী হন। দু’এক জন আছেন শৃঙ্খলা ছাড়া চেষ্টা করেন তবে ফলাফল শূন্য। রোগীর প্রাথমিক যাত্রা আরম্ভ হয় টিকেট ক্রয়ের মাধ্যমে। পরবর্তীতে প্রথম পর্যায়ে অনেকগুলো বাছাই কক্ষের মধ্য থেকে রোগের ধরণ বিবেচনা করে এক একটি বিশেষায়িত ইউনিটে প্রেরণ করা হয়। যেমন শুধু দৃষ্টিশক্তির সঠিকতা নিরূপণ, হালকা আঘাত জনিত রোগী, চোখের ভিতরের ক্ষত জনিত রোগী, গ্লুকোমা, রেটিনা, শিশু ইউনিট, ছানি, স্নায়ুজনিত চক্ষুরোগ, অরবিট (চোখের পাতা, অক্ষিগোলক ইত্যাদি রোগ) শিশুদের চোখের ক্যানসার, কৃত্রিম চোখ, লো ভিশন (বড় করে দেখার গ্লাস, কনটাক্ট লেন্স) লেজার, ক্যানসারের কেমোথেরাপী ইত্যাদি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সেবার অন্যদিক হলো যে সকল প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত চক্ষু রোগীর ছানি অপারেশন, স্নায়ুজনিত সমস্যা, জটিল চক্ষু রোগ নিয়ে হাসপাতাল আসেন তাদের অনেকেই চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে ১/২ দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ভর্তিযোগ্য রোগীরা আর্থিক সংগতি বিবেচনা করে কেবিনে অথবা ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ভর্তিকৃত রোগীরাও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা ছাড়াও অভিজ্ঞ; নিবেদিত চক্ষু কর্মীদের সেবা, দৈনন্দিন দেখাশুনার পরশ পেয়ে থাকেন। হাসপাতালের রান্নাঘরে রোগীদের উপযোগী সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার রান্না করা হয়। কেবিনে রোগীর সাথে একজন সহায়তাকর্মী থাকার অনুমতি থাকলেও ওয়ার্ডে রোগী একা থাকতে হয়। শুধু শিশুদের বেলায় একজন অভিভাবক সাথে রাখার অনুমতি দেয়া হয়। সবকিছুই শৃঙ্খলার আবর্তে বিদ্যমান চক্ষু সেবা যা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় একই পরিবেশ বা সেবা পাওয়া একটু কঠিন বটে।
দৈনন্দিন সকাল থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত চক্ষু চিকিৎসা সেবা চলতে থাকে। তারপরও বৈকালিক চক্ষু সেবা বিকাল ৩ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত দেয়া হয়। জরুরী সেবা ২৪ ঘন্টাই থাকে। তাছাড়া সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত “এক্সপ্রেস সার্ভিস” রয়েছে যা অনেকটা ওয়ানস্টপ সার্ভিস নামেই পরিচিত। প্রতিদিন প্রায় ১,২০০ রোগী বহিঃবিভাগের মাধ্যমে সেবা দেয়া হলেও “এক্সপ্রেস সার্ভিস” এ মাত্র ১০০ জন রোগী আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে টিকেট ইস্যু করা হয়। বছরের সকল সময় গ্রামের রোগীর সংখ্যা সমান থাকে না। বৃষ্টির দিনে, ধান কাটার মৌসুমে কম আসে। তাছাড়া গরীব রোগীদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা সেটা অপারেশনের ক্ষেত্রে বা শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে।
সবচেয়ে যে বিষয়টি রোগী, রোগীর সহযোগী বা এমন কি বাহিরের লোকদেরকে আকর্ষণ করে তা হচ্ছে হাসপাতালের গাছ-গাছড়া, ফলমূলের গাছ, ফুলের গাছ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্য যা একদল সেবাকর্মী (Hygienic Helper / Gardener) এর দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিচর্যা করা হয়ে থাকে। হাসপাতালের কর্ণধার সমাজকর্মী তথা বৃক্ষপ্রেমী ডাঃ রবিউল হোসেনের অনুপ্রেরণায়ই এসকল কর্মকাণ্ড জীবন্ত আকারে কর্মকর্তা, চিকিৎসক, কর্মচারীর মাঝেও প্রকৃতি প্রেমী করে তুলেছে। এ কর্ণধারের শিক্ষা, মেধা, প্রজ্ঞা, ধ্যান-ধারণা সবকিছুই মিশে আছে হাসপাতালের মাটির সাথে, ভবনের সাথে ও পরিবেশের সাথে।
চট্টগ্রামবাসীর অনেকেই হয়ত চক্ষু মেলে হাসপাতালের পরিবেশ ও কর্মকাণ্ড দেখেন নাই।
লেখক : প্রাবন্দিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির ভূয়সী প্রশংসা থাইল্যান্ড রাষ্ট্রদূতের
পরবর্তী নিবন্ধকর পুনঃমূল্যায়ন সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করে নগরবাসীর আস্থা অর্জন করতে হবে