দূষণ গ্রামকেও গ্রাস করছে!

বাসুদেব খাস্তগীর | শনিবার , ২১ মে, ২০২২ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

কবি জসীম উদ্‌দীন তাঁর বিখ্যাত নিমন্ত্রণ কবিতায় বলেছিলেন ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়, গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়।’ গ্রামীণ পরিবেশের এমন চমৎকার বর্ণনা কবি জসীম উদ্‌দীনের নিমন্ত্রণ কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে কী চমৎকারভাবে। আমাদের ছোটবেলায় যখন শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক এমন গ্রামীণ পরিবেশের বর্ণনা সমৃদ্ধ কবিতা পড়াতেন, মনে হতো সে চমৎকার পরিবেশ সমৃদ্ধ গ্রামেই তো বসবাস করছি। এ যেন আমাদের চিরচেনা গ্রামেরই প্রতিচ্ছবি। এদেশের প্রত্যেক গ্রামের শিশুকিশোরদের কাছে এ রকম গ্রামীণ সমাজের ছবি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। শহরের কোলাহল ছেড়ে মনের একটু শান্তির জন্য অনেকে আজও গ্রামে ছুটে যান। কিন্তু গ্রাম কি সেই আগের মত আছে? উত্তর হবে- না। কেননা তার অনেক ব্যাখা। বলতে পারেন গ্রামে এখন নাগরিক জীবনের ছোঁয়া। ছোটবেলার সবুজ শ্যামল, একদণ্ড প্রশান্তির নির্মল বিনোদনের সেই গ্রাম আজ উন্নয়নের ছোঁয়ায় প্লাবিত। দীর্ঘদিনের গ্রাম বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো হঠাৎ গ্রামে গেলে ছেলেবেলার গ্রামের সাথে এখনকার গ্রামের চিত্র মেলানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে। এই উন্নয়নের চিত্র বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই ঘটেছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তারপরও গ্রাম মানে যেন সকলের নিবিড় এক প্রেমের টান, শিকড়ের টান। ঈদের সময় দেশের লাখো লাখো মানুষ গ্রামের টানে শহর ছাড়ে। এটি যেন আমাদের গ্রাম বাংলার আবহমান চিরায়ত এক ঐতিহ্য। নানা ধর্মের মানুষের মধ্যেও নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবে শহর ছেড়ে গ্রামের নির্মল বাতাসে মিলিত হবার বাসনা সেই চিরকাল থেকেই। কিন্তু গ্রামের নির্মল পরিবেশে যেন আজ ভাটা। নানা কারণে গ্রামের পরিবেশের সেই চমৎকারিত্ব আর জৌলুস যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তার কিছু কারণকে এখানে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- জনসংখ্যা বৃদ্ধি- দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে চাপ সে চাপের প্রভাব শুধু বা নগরই নয় প্রভাব পড়েছে সুদূর গ্রামেও। আর অতিরিক্ত জনসংখ্যা মানে পরিবেশ দূষণ। স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে সাড়ে সাতকোটি মানুষের দেশে এখন জনসংখ্যা সতের কোটিরও বেশি। এ বিপুল জনসংখ্যার চাপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে গ্রামীণ নির্মল পরিবেশের ওপর। বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নালা নর্দমা ভরাট, অতিরিক্ত ঘনবসতিসহ নানা কারণ গ্রামের সেই অনাবিল সৌন্দর্যকে বিঘ্নিত করেছে।
পানিদূষণ- আজকাল গ্রামেও ঘটছে ব্যাপকভাবে পানিদূষণ। পানি দূষণের এই মাত্রা আমরা শুধু শহর বা নগর কেন্দ্রিক তথ্য নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতাম। কারণ বেশির ভাগ শিল্পাঞ্চল শহর বা নগর কেন্দ্রিকই ছিলো। সেখানে শিল্পের বর্জ্য মিশে নদী নালার পানিকে দূষিত করতো। সেই দূষণের ফলে মশা মাছি বৃদ্ধি, নদীর মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস ও খাবার পানির সংকটসহ নানা ঘটনা আমাদের দৃশ্যপটে এসে আলোচনায় আসতো। সেই দূষণের মাত্রাও ছড়িয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলে অতিরিক্ত বসতির কারণে বসেছে অতিরিক্ত টিউবওয়েল। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। আর পানিতে আয়রন ও আর্সেনিক পানিকে দূষিত করছে। গ্রামে গিয়ে সেই নির্মল বিশুদ্ধ পানি পান করার সেই দিন যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে দেখা যেতো এক সময়ে গ্রামের বধূরা দল বেঁধে নদীতে আসতো। ধোঁয়ামোছাসহ কলসী কাঁধে করে নদীর পানি নিয়ে যেত বাড়িতে। সেই পানি ব্যবহার হতো গৃহস্থালীর কাজে। সেসব দৃশ্য আজ বিরল। কলসী কাঁধে করে পানি নিয়ে যাবার দৃশ্য নিয়ে কত না পল্লীগান, কত না কবিতা রচিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে কত না নাটক ও চলচ্চিত্র। নদী পাড়ের অনেক মানুষ গোসল করার পর্ব সারতো এই নদীতেই। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে সেই নদীকে আর চোখে পড়ে না। নদীর ভাঙন, নদী ভরাট করে সংকুচিত করা, বর্জ্য ফেলাসহ নানা কারণে গ্রামের সেই নদীও নেই, নদীর সেই বিশুদ্ধ পানিও নেই। নদী খাল বিলে বিশুদ্ধ পানির অভাবে এখন কমে গেছে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন।
বায়ুদূষণ- বায়ুদূষণ শহর নয় গ্রামকেও আচ্ছন্ন করেছে ব্যাপকভাবে। গ্রামের উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে একটি শ্বাস নেয়ার আনন্দই ছিলো আলাদা। কিন্তু সেই উন্মুক্ত প্রান্তরও আজ ক্রমেই ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর বাতাসে ছড়াচ্ছে শিল্পায়নের প্রসারতার নামে বিষাক্ততা। গ্রামে নানা ধরনের ক্ষুদ্র শিল্পের পাশাপাশি ইট তৈরির ইটভাটার ব্যাপকতা ব্যাপক বায়ু দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সমগ্র বিশ্বে বছরে যে প্রায় ১৫০০ বিলিয়ন ইট উৎপাদিত হয়। এ ইটের ৬৭ শতাংশ চীনে, ২১ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বাকি ১২ শতাংশ বিশ্বের অন্যান্য দেশে উৎপাদিত হয়। এই দক্ষিণ এশিয়ায় উৎপাদিত ইটের ৮১ শতাংশ ভারতে, ৯ শতাংশ বাংলাদেশে, ১ শতাংশ নেপালে এবং বাকি ৯ শতাংশ অন্যান্য দেশে উৎপাদিত হয়। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। জিডিপিতে ইটশিল্প প্রায় ১ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ দেশের ইটখোলাগুলোয় কর্মরত। এই ইটভাটার অধিকাংশ গ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। কয়েক দশক আগেও এত ইটভাটা ছিল না। প্রয়োজনে বাড়ছে, কিন্তু গ্রামের পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকরি উদ্যোগ নেই। পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটাতে গাছের লাকড়ি ব্যবহৃত হয়। ফলে ইটভাটার চিমনী থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া গ্রামের বায়ুকে দুষিত করছে। মাঝে মাঝে ইটভাটাতে অভিযান হয়, মিডিয়াতে আসে, পরে সেসব খবর আবার হারিয়ে যায়। গ্রামে ডিজেল চালিত শ্যালো মেশিন, নসিমন, করিমন নামক ডিজেল চালিত গাড়ির ব্যবহারের ফলে গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়াও গ্রামে বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। ভূমিদূষণ বা মাটিদূষণ- কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটি দূষণ ঘটছে। ইটভাটার মাটি সংগ্রহের জন্য কৃষিজমির উপরিভাগ কেটে ফেলায় উর্বরতা শক্তিসম্পন্ন মাটি চলে যাচ্ছে, যা পূরণ করতে দীর্ঘদিন বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এ সার প্রয়োগও গ্রামের নির্মল পরিবেশকে দূষিত করছে। এ ছাড়া শ্যালো মেশিনের সাহায্যে নদী থেকে ভূগর্ভস্থ বালি তোলা হচ্ছে ব্যাপক হারে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকা দেবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বালি উত্তোলনের ফলে গ্রামের বিভিন্ন নদীতে ভাঙন দেখা দেয়, বন্যা দেখা দেয়, মানুষ ঘরবাড়ি হারা হচ্ছে। গ্রাম হয়ে পড়ছে শ্রীহীন।
শব্দদূষণ- গ্রামাঞ্চলে যানবাহন হিসেবে ভটভটি, নছিমন, করিমন জাতীয় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, যা শব্দদূষণ ঘটায় ব্যাপক হারে। এছাড়া গ্রামে নিয়ন্ত্রণহীন মাইকের ব্যবহারও ব্যাপক।
ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার- গ্রামে বিভিন্ন জায়গায় একসময় যে ঝোপ-জঙ্গল ছিলো তা গ্রামে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে এখন অনেকটা চোখে পড়ে না। গ্রামের অনিন্দ্য সুন্দর এসব জায়গায় শিশুকিশোররা একসময় খেলায় মেতে থাকতো। অনেকের দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি জড়িত আছে এসব লতাপাতায় ঘেরা গ্রামের মেঠোপথে। এখন গ্রামে গেলে এসব চোখে পড়ে না। নানা অজুহাতে সেসব পরিষ্কার করে মানুষ গড়ে তুলেছে বসতি। আগে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর গাছ, ঝোপ-জঙ্গল ও ছোট ছোট বন ছিল। কিন্তু সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
খোলা মাঠের অপর্যাপ্ততা-গ্রামের সেই খোলা মাঠও এখন নেই। দু’একটি হয়তো কোথাও কোথাও টিকে আছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তা হ্রাসই পেয়েছে। গ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে মাঠ ভরাট হয়েছে, পুকুর, ডোবা নালা ভরাট হয়েছে। পরিবেশের রক্ষার কথা তেমন কেউ ভাবছে না। বাণিজ্যটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরায়ণের ঢেউ শহর ছাড়িয়ে গ্রামে পাখা মেলছে। গ্রামীণ পরিবেশ নিয়ে মানুষের যে আবেগ সে আবেগ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ গ্রাম এখন আর প্রাকৃতিক শোভা মণ্ডিত গ্রামের জৌলুস থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।
গ্রামীণ পরিবেশের বর্তমান এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইতিবাচক ভাবনা সবার দরকার। গ্রাম হচ্ছে আমাদের শিকড়। শিকড়ে পচন ধরলে সর্বনাশ। শহরে যতটুকু পরিবেশ সচেতনতা আছে গ্রামে তার অভাব প্রচুর। গ্রামীণ ঐতিহ্যের যে নির্মল পরিবেশ তা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যেরই অংশ। কারণ উন্মুক্ত আকাশের নিচে হাত ছড়িয়ে একদণ্ড নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হিসাবে গ্রামকেই আমরা ভাবনায় রাখি। গ্রামীণ পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বাড়ানো, পরিবেশ রক্ষার বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আরও যত্নশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের সান্নিধ্য
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে