(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মানুষ গিজগিজ করছিল। সবাই ছুটছে। কেউ সামনে কেউ পিছনে। যেনো একটুও থামার সময় নেই, চারদিকে শুধুই ব্যস্ততা! তবে আমাদের কোন তাড়া ছিল না, হেলে দুলে হাঁটছিলাম আমরা। অবশ্য পুরো স্টেশনে আমাদের মতো হেলেদুলে হাঁটছে এমন আর দ্বিতীয় মানুষটির দেখা পেলাম না। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। ইউছুপ আলী ভাই এবং ভাবীকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। এক সময় উনারা অদৃশ্য হয়ে গেলে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। কিন্তু পা যেন সরছিল না। এগুতে পারছিলাম না সামনে। কেমন যেন এক পিছুটান টের পাচ্ছিলাম। আহা, অসুস্থ মানুষটা শুধু বন্ধুকে একটু দেখার জন্য হংকং থেকে ছুটে এসেছিলেন গুয়াংজুতে। একা আসতে পারবেন না, তাই বাচ্চাদের একা রেখে ভাবীকেও নিয়ে এসেছিলেন সাথে। বন্ধুত্বের জন্য এমন প্রেমময় মানুষ জগতে খুব বেশি আমি দেখিনি। কোন চাওয়া পাওয়া নেই, নেই কোন হিসেব নিকেশ। শুধু বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য এমন আকুতি মানুষের অন্তরে থাকলে সেই মানুষ কোনদিনই একা হয়না।
আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে একজন ভালো বন্ধু পৃথিবীতে বিধাতার অনেক বড় উপহার। যার জীবনে ভালো বন্ধু নেই তার অনেককিছু থাকলেও তিনি অভাগা। টাকা কড়ি অঢেল থাকলেও শুধুমাত্র বন্ধুর অভাবে জীবনটা অনেকসময় অর্থহীন হয়ে উঠে। নিজের খারাপ লাগাটা প্রাণখুলে কারো সাথে শেয়ার করার জন্যও বন্ধু লাগে। এদিক থেকে আমি অনেক ভাগ্যবান। সেই ছোটবেলা থেকেই বন্ধু নিয়েই আমার বেড়ে উঠা। প্রচুর বন্ধু আমার, দেশে কিংবা বিদেশে! আমার অগুনতি বন্ধুর মধ্যে এত ভালো কিছু বন্ধু আছে যে তাদের কাজ-কারবার দেখলে অন্তর ভরে যায়, চোখ ভিজে উঠে। এসব বন্ধুর সাথে আমার আর্থিক কোন সম্পর্ক নেই, তবে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। যে সম্পর্কের জোরে বন্ধুরা বন্ধুত্বের জন্য অনেক কিছু করতে পারে।
ভাবীকে নিয়ে ইউছুপ আলী ভাই চলে গেলেন। চলে যে গেলেন সেটা যেমন সত্যি, তেমনি তার ঘরে ফেরা যে আনন্দের নয় সেটা আরো বড় সত্যি। আমাকে গুয়াংজু রেখে উনি ফিরে যাওয়ার সময় চেহারায় যে মলিনতা দেখেছি তা ভুলতে পারছিলাম না। স্টেশনে বিদায় নেয়ার সময়ও মুখের হাসিটা অন্যরকম ছিল, ছিল বিষাদে মাখা। চলে যাওয়ার সময় বারবার পেছনে ফিরে দেখছিলেন। আহা, আর কী দেখা হবে! ইউছুপ ভাইর চোখের কোণ কী চকচক করছিলো!! আমারও বুকটা কী ভারি হয়ে উঠেছিল! কষ্ট হচ্ছিল কী নিঃশ্বাসে!!
স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আমরা মানে আমি এবং ইউছুপ আলী ভাইর অফিসের কর্মকর্তা কায়সার ভাই এবং জোবায়ের। কায়সার ভাই বললেন, চলেন, শেনজেন শহরটা একটু ঘুরেটুরে দেখি। তারপর কোথাও কিছু খেয়ে ফেরার পথ ধরবো।
শহরের রাস্তা ধরে ছুটছিল আমাদের গাড়ি। রাস্তায় শত সহস্র গাড়ি। নানা মডেলের, রকমারি ব্র্যান্ডের। কিন্তু একটিও পুরাতন গাড়ি চোখে পড়লো না। সবগুলোই চকচক করছে। ইউরোপ আমেরিকার রাস্তায় নতুন গাড়ির কাফেলা দেখেছি, কিন্তু চীনে গাড়ির এমন জয়জয়কার! প্রচুর গাড়ি রাস্তায়, কিন্তু যানজট দেখলাম না। অটো ট্রাফিক সিগন্যাল, লাল সবুজ হলুদ বাতির তালে তালে গাড়ি চলে। রাস্তার নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পারাপার হয় মানুষ। জেব্রা ক্রসিং এবং সিগন্যালের লাইট ছাড়া পারাপারের কোন সুযোগ নেই। রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড় দেয়ার একটি দৃশ্যও দেখা গেলো না শেনজেনের ব্যস্ত রাজপথে।
রাস্তার দু’পাশে সুউচ্চ সব ভবন। সুউচ্চ মানেই সুউচ্চ, একেবারে আকাশ ফুটো করে দেয়ার মতো সব ভবন। নানা রঙের নানা ঢঙের! কত ধরনের ডিজাইনের ভবন যে তৈরি করা হয়েছে। পঞ্চাশ ষাট তলা উচ্চতার ভবন যেন হাতের মোয়া! অসংখ্য। যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে ৭০/৮০ তলার ভবন। শেনজেনের সর্বোচ্চ ভবনের উচ্চতা কত? কায়সার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। না, তিনি বলতে পারলেন না। বললেন, ১০০-২০০ তলা হতে পারে। আমরা তো গুয়াংজু থাকি, এখানে খুব আসা হয় না। তাই এই শহরটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আমি গুগুলের সহায়তা নিয়ে চমকে উঠলাম। সত্যি বলতে কী, পিলে চমকানো মনে হয় একেই বলে। ছবির মতো সুন্দর শহরটিতে সুউচ্চ ভবনের যে তালিকা দেখছি তাতে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। শহরটিতে ৫০ তলার উপরের ভবন রয়েছে ৬০টিরও বেশি। পিং এ্যান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স সেন্টার ১১৫ তলা উচ্চতা। ৫৯৯ মিটার বা ১৯৬৫ ফুট উচ্চতার ভবনটি বছর কয়েক আগে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এটিকে এখন ডিঙ্গিয়ে ফেলা হয়েছে। আরো বেশ কয়েকটি ভবন তৈরি হচ্ছে এটির চেয়ে অনেক বেশি উঁচু। তবে এগুলোর কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলেও পুরোপুরি প্রস্তুত হতে আরো কিছু সময় লাগবে। শেনজেনে তৈরি হচ্ছে ২০২ তলা উচ্চতার কিয়ান হাই টাওয়ার। ৩৩শ’ ফুট উঁচু ভবনটির পাশে কিয়ান হাই টাওয়ার -দুই, কিয়ান হাই টাওয়ার -তিন নামের ধারে কাছের উচ্চতার আরো কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আমি আবারো লিখছি , ২০২ তলা!! চিন্তা করা যায়? ৩৩শ’ ফুট! আমাদের দেশের সাধারণ ভবনের উচ্চতায় হিসেব করলে ৩৩০ তলা (এক ফ্লোর দশ ফুট হিসেবে)। ভবন মাথা দেখতে নিজের মাথার টুপি পরে যাওয়ার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি মাথাসহ রাস্তায় শুয়ে পড়তে হবে! মাথা সোজা রেখে এমন ভবনের উপরের তলায় চোখ দেয়া যে অসম্ভব তা বাঁকা হতে হতে বেশ টের পাচ্ছিলাম। অনতিদূরে নির্মিত হচ্ছে ২১৯২ ফুট উঁচু ১৪০ তলার শিমাও শেনজেন- হংকং সেন্টার। এই টাওয়ারের নির্মাণকাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। সবকিছু মিলে চারদিকে এত এত্ত উঁচু উঁচু ভবনের মাঝে নিজেকে পিঁপড়ার মতো মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি এক লিলিপুট। আহা, মাঝে মধ্যে কেন যে এত অসহায় লাগে!
আমরা ঘুরছিলাম শহরের ভিতরে, কোন গন্তব্য ছাড়া। এই রাস্তা থেকে ও রাস্তা ধরে ঘুরছিলাম। শুধু শুধু শহর দেখার জন্য চক্কর দেয়া। কখনো রাস্তার উপর, কখনো ওবারপাসের উপর, আবার কখনো ভবনের নিচ দিয়ে ছুটছিলাম। এক পথ থেকে অন্যপথে বেশ দক্ষতার সাথে গাড়ি চালাচ্ছিল আমাদের চালক। এসব রাস্তায় গাড়ি চালানোর সুখই অন্যরকম। স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা! রাস্তা কী সুন্দর! পিচঢালা সাধারণ রাস্তা, কিন্তু কী যে মসৃণ! মাখনের মতো মোলায়েম মনে হচ্ছিল। রাস্তার দু’ধারেই ফুটপাত, সাইকেলের রাস্তা। এরপর চমৎকার বাগান। বাগানের ধাঁচও অন্যরকম। ফুটপাতের পাশে কয়েক ফুট উঁচু করে মাটি দিয়ে ঢিপির মতো তৈরি করা হয়েছে। ওই মাটিকে দেয়া হয়েছে ছোট পাহাড়ের আদল, ঢালু। রাস্তা থেকে দেখে মনে হয় কয়েকফুট উঁচু পাহাড়ের ঢাল। ওই ঢাল থেকে শুরু হয়েছে পাশের অবকাঠামোর ভিটি। আর ওই ঢাল জুড়ে ফুটে আছে থোকায় থোকায় ফুল। একটি দুইটি ফুল নয়, রাস্তার দুপাশের মাইলের পর মাইল পথে ফুটে আছে নানা রঙের বাহারী ফুল। ফুটপাতের পাশজুড়ে যেন ফুলের ছাদর! নয়ন মন জুড়িয়ে দেয়া মনে হয় একেই বলে! একেই বলে বুঝি বিশ্বমানের শহর! আবারো বুকের বাম পাশটাতে কেমন যেন করতে লাগলো। বিশ্বমানের শহর! গত ক’বছরে কথাটি অসংখ্যবার লিখেছি! তবে ঠিক কোন পর্যায়ের মানকে ‘বিশ্বমান’ বলে তা যেনো আজ দেখতে পাচ্ছি!!
সন্ধ্যা জমে উঠছিল। চারদিকে আলোর এমন বান শুরু হলো যে ঠিক সন্ধ্যা বলে মনে হচ্ছিল না। স্ট্রিট লাইটের পাশাপাশি প্রতিটি ভবন থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। পিচঢালা কালো রাজপথ এমন চকচক করছিল যে, একটি সূচ পড়লেও খুঁজে নেয়া সম্ভব। আলোর ঝলকানি চারদিকে। সুউচ্চ ভবনগুলোর পুরো দেয়াল যেনো মনিটর! এক একটি ভবন যেনো এক একটি টিভি। বিজ্ঞাপনচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল। কত ধরনের পণ্যের কত বিজ্ঞাপন! প্রচারেই প্রসার, চীনের ব্যবসায়ীরা এই সূত্রটিও বুঝি বেশ রপ্ত করেছে! নিজে নিজে হাসলাম, পুরো পৃথিবীকে বাণিজ্য ঘাটতির মুখে ফেলে দেয়া চীনের ব্যবসায়ীরা ব্যবসার সব সূত্রই শুধু মুখস্থ নয়, আত্মস্থও করে রেখেছে! (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী