দিল্লী শহরের নানা প্রান্তে ঘুরলাম। কোন কারণ ছাড়াই ঘুরলাম। গাড়িতে ঘুরতে হবে বলে ঘুরলাম বললেও অত্যুক্তি হবে না। কখনো রাস্তায় নেমে বেলপুরি খেলাম, কখনো ফুচকা বা চটপটি। রাস্তার পাশের টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলাম। ঘুরলাম আলীশান সব শপিং মল। চোখ ধাঁধানো নানা জিনিস যেমন দেখলাম, তেমনি রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষের সাথেও দেখা হলো। নান্দনিকতার পাশাপাশি অসুন্দর জিনিসের ছড়াছড়িও রয়েছে দিল্লীর হেথায় হোথায়। দৃষ্টিনন্দনের ভবন এবং বস্তী মিলে দিল্লীর জীবন একাকার। কোথাও শান শওকতের অভাব নেই, কোথাও অভাবের যেন শেষ নেই। কয়েকশ’ বছরের রাজধানী দিল্লীতে জৌলুশের পাশাপাশি অন্ধকারও প্রকট। বিশ্বের অন্যতম এই মেগাসিটিতে মানুষ গিজগিজ করে। সুখী সুখী মানুষের পাশাপাশি জীবন-জীবিকা নিয়ে দিশেহারা মানুষের কাফেলাও খুব ছোট নয়।
দিল্লী শহরে আগেও বার দশেক আসা হয়েছে আমার। ধারে কাছের শহরগুলোর মধ্যে কলকাতা এবং দিল্লীতে এত বেশি আসা হয়েছে যে তা হিসেব করতে পাসপোর্টের সিল দেখতে হয়। দিল্লীর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণে নয়, কেমন করে যেন আসা হয়ে যায়, চলে আসি। এবারও নানা পথ মাড়িয়ে ঠিকই দিল্লীতে এসে হাজির হয়েছি। চেন্নাই, সিমলা এবং চন্ডীগড় হয়ে দিল্লীতে চক্কর মারছি। যদিও চেন্নাই থেকে দিল্লী দূর অস্ত, বহুদূর!
আমরা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং মোটামুটি মানের একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। রুটির সাথে চিকেন এবং ডাল পালং। রান্না অসাধারণ। তবে ধারণার বাইরে বিল আসায় কিছুটা চমকেও উঠেছিলাম। আমাদের খাবারের বিলের সাথে ড্রাইভারের জন্য কমিশন যুক্ত করে দেয়া হয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না। হাতে তৈরি ছয়টি রুটির সাথে তিন টুকরো চিকেন এবং একটু ডাল পালং এর দাম দুই হাজার রূপিরও বেশি হওয়া অস্বাভাবিক ঠেকলো আমার কাছে। কিন্তু হিন্দি ভাষায় কথোপকথনে দুর্বলতার কারণে বিশেষ কিছু জানাও হলো না। সবচেয়ে বড় কথা বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ করলে লোক জড়ো হবে ঠিকই, বিলও হয়তো কমবে। তবে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে টানাটানি হবে। তাই নিরবে বের হয়ে এলাম। রাস্তার পাশের মোটামুটি মানের একটি হোটেলে খাবার খেয়ে মনে হলো ফাইভ স্টার হোটেলের বিল পরিশোধ করলাম। এভাবে ঠকে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল, নিজেকে মনে হচ্ছিল ভীষণ বোকা। প্রিয়তমা স্ত্রী বারবার আমার হাত চেপে ধরছিল। বলছিল, বাদ দাও। কি হবে, মনে করো পিক পকেট হয়েছে। তার ধারণা বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা করলে দিল্লীতে বিপদে পড়ে যাবো। ড্রাইভারকে কিছু বললে তিনি উল্টো পথে ঘুরিয়ে নতুন বিপদে ফেলবেন। অচিন জায়গায় বহু কিছু হজম করতে হয় বলেও সে আমাকে চবক দিতে লাগলো। আমরা কথা বলছিলাম বাংলায়। ড্রাইভার তার কিচ্ছু বুঝতে পারছিলেন না। যেই খাবারের বিল নিয়ে মাথায় খুন চাপার উপক্রম ড্রাইভার সেই খাবার কেমন ছিল জানতে চাইলেন। কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বললাম, বহুত আচ্ছা! অবশ্য ড্রাইভার আমার ব্যঙ্গ ধরতে পারলেন না। তিনি মাথা নাড়লেন। জানালেন, বেশ মজা করে খেয়েছেন। তিনি আমাদের ধন্যবাদও দিলেন।
চাঁদনী চৌক মার্কেটে ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেল। অনেক আগে একবার এসেছিলাম। তখনো ভিড় ছিল, তবে এত ছিল না। মানুষ গিজগিজ করছে। মার্কেটের দোকানে দোকানে নানা পণ্যের পসরা। ভীষন ব্যস্তভাবে চলছে বিকিকিনি। আমার স্ত্রী কয়েকটি দোকানে ঢুঁ মারলো। কিছু শাড়ি টাড়িও দেখলো, কিনলো। শাড়ির প্রতি নারীর দুর্বলতা অনন্তকালের। তাই এই দুর্বলতা থেকে আমার স্ত্রীও বেরুতে পারলো না। কলেজে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই শাড়ি পরতে হয় তাকে। এতে করে তার শাড়ি লাগেও। খুব ভালো না বুঝলেও এটুকু বুঝি যে তার শাড়ির ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। নিজেই পছন্দ করে কিনে, আমাকে কখনো মাথা ঘামাতে বা টাকা যোগাতে হয় না। অতএব ওসব নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহও থাকে না। শপিং এর প্রতি তার তেমন কোন দুর্বলতা নেই। তবে চাঁদনী চৌকে শাড়ির দোকানগুলোর কয়েকটিতে চক্কর দিয়ে কেন যে একটিতে বসে পড়লো কে জানে! আমাকে যা বললো তার অর্থ হচ্ছে, শাড়িগুলো বেশ ভালো, দামও কম। আমাদের দেশের তুলনায় নাকি চাঁদনী চৌকে শাড়ির দাম অনেক কম। একটি শাড়ি আমাকে দেখিয়ে বললো, তুমি খাবারের রেস্টুরেন্টে যে টাকা ঠকেছো বলে মনে করছো তার থেকে বহু বেশি এই শাড়িতেই ফিরে আসলো। এই শাড়ি দেশে কিনে পরতে দ্বিগুনের কাছাকাছি দাম দিতে হতো বলে সে হাসলো। শাড়ি কিনে পকেটের টাকা খরচ করার মধ্য দিয়ে কি করে যে রেস্টুরেন্টে ঠকা টাকা ফিরে আসলো কে জানে! ঘরণীর বুদ্ধি মনে হয় একেই বলে! হাতে শাড়ীর প্যাকেট নিয়ে চাঁদনী চৌকের বিভিন্ন দোকানে ঘোরাঘুরি করলাম। কেনাকাটাও টুকটাক করা হলো। বেশ দরাদরি করে কিনতে হয়। ফিঙড প্রাইজ লেখা দোকানেও দেদারসে চলে দরদাম।
আরো নানা জায়গায় ঘুরলাম আমরা। রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, স্কট হাসপাতালসহ নানা স্থানে শুধু শুধু ঘুরলাম। বিকেলে নাস্তাও করলাম ফুটপাতে। বেলপুরি এবং চানাচুরের অপূর্ব সমন্বয়ে কি যেন একটা খেলাম লাইন ধরে। আস্ত একটি চৌচালা দোকানকে ঠেলাগাড়ির মতো একটি বাহনের উপর বসিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। রাস্তার পাশে বেশ বড় একটি গাছের তলায় সেই ঠেলাগাড়ি দাঁড় করিয়ে চলছে বিকিকিনি। ফুচকা চটপটি বেলপুরিসহ নানা ধরনের ঝাল খাবার। মাটির কাপে একটুখানি চা। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দোকানটিতে। কি দুর্দান্ত বেচাকেনা! হাজার হাজার টাকার ঝাল খাবার বিক্রি হচ্ছে দোকানটিতে। দু’জন লোক জিনিস দিয়ে কুল করতে পারছিলেন না। আমরা বেশ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার কিনতে হলো। ভাগ্য আসলে বিরাট একটি ব্যাপার। এমন অস্থায়ী একটি দোকানের বেচাবিক্রি বহু শানদার হোটেলেও হয় না বলে আমার মনে হলো।
রাত জমে উঠেছে অনেকক্ষণ হলো। চারদিকে আলোর বন্যা। দিল্লী শহর যেন জেগে উঠেছে। এক একটি শপিং মল যেন হাসছে। হাসছে আলীশান সব ভবন। দিল্লী শহর প্রতিদিনই যেন পাল্টে যাচ্ছে। নতুন নতুন ভবন হয়েছে, হচ্ছে। বাড়ছে জৌলুশ। ড্রাইভারকে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিতে বললাম। রাতের দিল্লীতে আর আমাদের ঘোরার তেমন কোন জায়গা নেই। দিল্লী শহরে অসংখ্য ক্লাব এবং বার রয়েছে। সেখানে এক একটি রাত বর্ণিল হয়ে উঠে। ভবনের দেয়ালজুড়ে আলোর বন্যা যেন সেই বর্ণিলতাই ঘোষণা করছে। নাইট ক্লাব বা বারের প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণ নেই। রাতের দিল্লীর উপর খুব একটা ভরসাও নেই। তাই আর ঘোরাঘুরি না করে হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ড্রাইভার বেশ নিবিষ্ট মনে গাড়ি চালাচ্ছেন। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, মানুষ। দিল্লী শহরের এই অংশটিতে ফুটপাত ধরে ছুটছে হাজার হাজার মানুষ। অবশ্য দিল্লীতে রাস্তায় এবং ফুটপাত ধরে রাতে দিনে চলে মানুষের ছুটে চলা। থামার কোন লক্ষনই যেন নেই কোথাও। দিল্লী শহরে প্রচুর গাছ। রাস্তায়, ফুটপাতে, মাঠে, মার্কেটের সামনে, বাড়ির আঙ্গিনা সর্বত্রই গাছ। বড় বড় গাছও রয়েছে অনেক। রকমারি গাছ যেখানে সেখানে। যেন গাছের অভাব নেই দিল্লীতে। এতে করে দিল্লী শহরের অধিকাংশ ফুটপাত বেশ সুন্দর। ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা। গাছের ছায়ায় ময়ূর ঘুরে বেড়ায় বহু এলাকায়। রাতের বেলায় খেয়াল করে দেখলাম যে, ফুটপাতগুলোতে আলো আঁধারীর দারুণ এক আবহ। বড় বড় গাছের ছায়া ফুটপাতজুড়ে বেশ মোহনীয় এক আবহ তৈরি করে রেখেছে।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী