আগরতলা মামলা-খ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাণিক চৌধুরী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ৩০ জুন, ২০২১ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

মাণিক চৌধুরী চট্টগ্রামের একজন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মান্য বক্তিত্ব ছিলেন। শুধু এটুকু বলা হলে মাণিক চৌধুরীর সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। কারণ তিনি যে কারণে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেটি হলো আগরতলা মামলা।
মাণিক চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু, লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, লিডিং সীম্যান সুলতান উদ্দিন আহমদ, সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, আহমেদ ফজলুর রহমান, আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই, একদা সিডিএর চেয়ারম্যান ও ড. জনমন- খ্যাত শামসুর রহমান, এবং আরো কয়েকজন বাঙালি রাজনীতিক ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো ক্যান্টনমেন্টে একযোগে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন , তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সারাদেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আইয়ুব সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, দায়ের করে। প্রথমে মামলার ১নং আসামী করা হয়েছিলো লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে, ২নং আসামী বঙ্গবন্ধু, ৩নং মাণিক চৌধুরী। তখনই মাণিক চৌধুরীর কথা সারাদেশের মানুষ জেনে যায়। পরে বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামী, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে ২নং এবং মাণিক চৌধুরীকে ১২ নং আসামী করা হয়। মামলার নামকরণ করা হয় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য।”
মাণিক চৌধুরীর আসল নাম ভূপতিভূষণ চৌধুরী। মা বাবার সাত রাজার ধন মাণিক। প্রথমে হাবিলাসদ্বীপ, পরে চট্টগ্রাম, শেষে বঙ্গবন্ধুর সূত্রে বাংলাদেশের মাণিক হয়ে যান ভূপতি। সত্যিই বাংলাদেশের মাণিক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের জন্যই তো তিনি তাঁর সমস্ত জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করেছিলেন।
নেতাজী সুভাষ বসু ছিলেন তাঁর আদর্শ। নেতাজীর জীবন ও সংগ্রাম থেকে তিনি বিপ্লবী রাজনীতির অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নেতাজীর ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তখনই বিপ্লবী রাজনীতিতে দীক্ষিত হন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন, সেটা ছিলো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক শুভক্ষণ। বঙ্গবন্ধু’র হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মাণিক চৌধুরী। তাঁর মানসপটে ছিলো নেতাজীর ছবি আঁকা, তাঁর পাশে এবার স্থাপন করলেন বঙ্গবন্ধুর ছবি। পঞ্চাশের দশকে গঠনোন্মুখ বাঙালি রাজনীতির উদীয়মান নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নেতাজীর প্রতিচ্ছবিই যেন খুঁজে পেয়েছিলেন মাণিক চৌধুরী। নেতাজী, মাস্টারদা সূর্য সেন এরাই তো বিভাগ-পূর্ব বঙ্গীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছেন; ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে এম এল এ নির্বাচিত হয়েছেন। ওজারতিও করেছেন কিছুদিন। কিন্তু তাঁর মনের গহীনে লুকিয়ে ছিলো একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। মাণিক চৌধুরী স্বাধীনতার জন্য নেতাজীর আজাদ হিন্দু ফৌজের যুদ্ধের কথা জানেন। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের সঙ্গে নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুর অখণ্ড বাংলা পরিকল্পনার কথাও শুনেছেন তিনি। মাণিক চৌধুরী যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর চোখে মুখে অন্য রকম এক দীপ্তি দেখতে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন চট্টগ্রামের এই উদ্যমী যুবকটিকে মনের কথা খুলে বলা যায়। তাই বললেন একদিন। তাঁরা সহমত হলেন সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অতঃপর বাংলাদেশ অভিযানে বহির্গত হলেন দুই বঙ্গসন্তান-টুঙ্গীপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর শিষ্য চট্টগ্রামের মাণিক চৌধুরী। চট্টগ্রামে তাঁর আরো বন্ধু, সহকর্মী এবং অনুসারী ছিলো। কিন্তু তাঁরা তাঁর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সহযোগী; মাণিক চৌধুরীও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই করতেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ , এম আর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান- এঁরা চট্টগ্রামে তাঁর দলের এক একটি স্তম্ভ; জহুর- আজিজ-মোজাফফর-দোভাষ তো তাঁর বিশিষ্ট বন্ধুই। তাঁদেরকে নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু গোপন সশস্ত্র রাজনীতির জন্য শুধু বেছে নিয়েছিলেন মাণিক চৌধুরীকে আর সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরীকে। মাণিক চৌধুরীর মাধ্যমে তাঁর বন্ধু বিধান কৃষ্ণ সেনও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
তারপর তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে কর্মরত বাঙাালি সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে অত্যন্ত গোপনে সতর্কতার সঙ্গে যাদেরকে বিশ্বস্ত মনে হয়েছে, তাদেরকে রিক্রুট করে একটি বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। কয়েকজন বাঙালি সিএসপি অফিসার ও ব্যবসায়ীকেও যুক্ত করলেন। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন অস্ত্র ও স্বাধীন দেশের প্রতি সমর্থনের জন্য। কিন্তু নেতৃস্থানীয় একজন সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতায় পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী (আই এস আই) সব জেনে যায়। তারপর আগরতলা মামলা এবং বাকিটা ইতিহাস। বিপ্লবী সংগঠনের অনেক কিছুই চট্টগ্রামে হয়েছে। রেয়াজউদ্দিন বাজার ১২নং চৈতন্য গলিতে ডা. ছৈয়দুর রহমানের বাসভবন। সেই বাড়িটিকে বিপ্লবের আঁতুরঘর বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বঙ্গবন্ধু , লে কমান্ডার মোয়াজ্জেম, মাণিক চৌধুরী, ডা. ছৈয়দ, লিডিং সিম্যান সুলতান, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান- দিনের পর দিন সেই বাড়িতে বসে বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছেন। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাণিক চৌধুরীই ছিলেন মুখ্য ব্যক্তি। ৬৮ সালে পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও ৭১ সালে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ কাজে লেগেছিলো। সেজন্য মাণিক চৌধুরীই কৃতিত্বের দাবিদার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাণিক চৌধুরীর সম্পর্ক বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জটিল গ্রন্থি। বঙ্গবন্ধু ও মাণিক চৌধুরী দু’জনই আজ প্রয়াত। ফলে এই জটিল গ্রন্থি উন্মোচন আর কখনোই সম্ভব হবে না।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড়সহ অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে দিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীসহ প্রথম সারির সব আওয়ামীলীগ নেতাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হলে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। অবশেষে আমেনা বেগমের ওপর সাধারণ সম্পাদকের ভার অর্পিত হয়। মাণিক চৌধুরীকেও এ সময় গ্রেফতার করা হয়। পরে মুক্তি পান তিনি। এই সময় মাণিক চৌধুরী অসমসাহসী ভূমিকা পালন করেন। ৬ দফাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি ঢাকা চট্টগ্রাম ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক ও প্রচারমূলক কাজ চালান। চট্টগ্রামে ইদরিস আলম, আশরাফ খান, বদন দীদারি, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, শাহ বদিউল আলম, জয়নাল আবেদিন প্রধান প্রভৃতিকে নিয়ে সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক ডা. ছৈয়দ ৬ দফা প্রচারের জন্য যে টিম গঠন করেছিলেন মাণিক চৌধুরীই ছিলেন তার উদ্যোক্তা। ঢাকায়ও তাঁর একটি টিম ছিলো, যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আলী হোসেন, খসরু, নিজাম, ফ্যান্টোমাস।
মাণিক চৌধুরী তাঁর সময়ের চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী এবং সর্বমহলে সমাদৃত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রভাববলয় ও বন্ধুত্বের পরিধি চট্টগ্রামের সমাজ জীবনের অনেক গভীরে নিহিত ছিলো। চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীগণ তাঁর বন্ধু নয়তো শুভাকাঙ্খী ছিলেন। মাণিক চৌধুরীর কী মহিমা! কী অপরিসীম দক্ষতায় তিনি নানা রুচির নানা জাতের মানুষের সঙ্গে অনায়াসে মেলামেশা করতেন এবং সম্পর্ক রেখে চলতেন, ভেবে ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার মানুষ, একটাই মিল মাণিক চৌধুরী কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। তাঁদের অভিন্ন বান্ধব বা সুহৃদ কিংবা প্রিয়জন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ