দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শত শত গাড়ি। রাস্তা জুড়ে আলো আঁধারীর চমৎকার এক আবহ তৈরি করে ছুটে যাচ্ছে গাড়িগুলো। আট লেনের বিরাট রাস্তা। বোথ ওয়ে। দুদিক থেকেই ছুটে ছুটে আসছে প্রচুর গাড়ি। আমরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। অপর পাশ ধরে কিছুদূর গেলেই আমাদের প্রত্যাশিত রোজ গার্ডেন। রাস্তা পার হতে হবে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখানে জেব্রা ক্রসিং নেই। দেশে হলে কোনাকুনি দৌঁড় দিতাম কিংবা মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেলে দুলে পার হতাম! বিদেশে বুকের পাটা সংকুচিত হয়ে যায়। তাই ইচ্ছে করলেও কোনাকুনি কিংবা শর্টকাটের সুযোগ নিতে পারি না। জেব্রা ক্রসিং ধরেই পার হতে হবে রাস্তা। কিন্তু কোথায় জেব্রা ক্রসিং? খোঁজ করলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, মোড়ের একটু আগে জেব্রা ক্রসিং রয়েছে। আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে গেলাম। আমাদের আগ থেকে আরো দুজন মানুষ জেব্রা ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছেন। ছিনতাইকারী নয়তো! গিন্নী আমার হাতটি শক্ত করে ধরলো। আমিও। কিন্তু আমাদের দেখে ওই দুব্যক্তির কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। মনে হলো তারাও রাস্তা পার হবেন। সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করছেন। সিগন্যাল? জ্বী, ভারতের চন্ডীগড়ের রাস্তায়ও ইউরোপ আমেরিকা কিংবা উন্নত দেশগুলোর মতো রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং রয়েছে। রয়েছে অটো সিগন্যাল। যেখানে লাল সবুজ হলুদ বাতি জ্বলছে। মানুষ পারাপারের জন্য এক বা দুই মিনিট সময় দেয়া হয়। চলে কাউন্ট ডাউন। ‘১০০’ থেকে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়। ‘১’ পর্যন্ত রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ থাকে। ‘১’ এর পর গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় মানুষের চলাচল। অটো ট্রাফিক সিস্টেম। সবকিছু ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। সবকিছুই।
মানুষের অবয়ব সম্বলিত সবুজ বাতি জ্বলা শুরু হয়েছে। আমরা রাস্তা পার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আট লেনের বিশাল রাস্তাটি পার হলাম। আমরা যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম তখন শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটি গাড়িও সিগন্যাল অমান্য করেনি। আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম যে, একটি গাড়িও রাস্তায় ট্রাফিক দাগ মাড়ায় নি। আইনের প্রতি কি পরিমাণ অনুগত থাকলে এমনটি করা সম্ভব তা ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে হাঁটছিলাম। স্ত্রীর হাত তখনো আমার হাতে। মনে পড়ছিল আমাদের ট্রাভেলার্সের চালকের কথা। বেচারা এই ধরনের একটি দাগ মাড়িয়ে কি বিপদেই না পড়েছিলেন!
জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছি আমরা। আমাদের আগে আগে হাঁটছেন আরো কয়েকজন। আমাদের গন্তব্য রোজ গার্ডেন, জাকির হুসেন রোজ গার্ডেন। আর কতদূর হাঁটতে হবে কে জানে! কিন্তু মোবাইলের জিপিএস দেখাচ্ছে যে, খুবই কাছে। জিপিএস-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ভুলের কোন আশংকা নেই। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই। আমি বেশ রিল্যাক্সে পথ চলছি। গোলাপের দিকে যাত্রা আমার অন্তরজুড়ে প্রেমময় এক ভাবের সৃষ্টি করেছে। স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে গুনগুন করে রবি ঠাকুরের গান গাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের টুংটাং শব্দ! আহ্‌, চন্ডীগড়ের মানুষতো বড্ড বেরসিক! পিছু ফিরলাম। বাহ, দারুণ স্মার্ট এক তরুণী সাইক্লিস্ট! তার রাস্তা থেকে সরে সাইড দেয়ার সংকেত দিচ্ছিল তরুণী। খেয়াল করলাম যে, আমরা যে পথ দিয়ে হাঁটছি সেটি ফুটপাত নয়, সাইকেলের রাস্তা। চন্ডীগড়ে সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তা! ইউরোপ আমেরিকায় দেখেছিলাম। দেখেছিলাম হংকং এ ও। চীনেও আছে। কিন্তু ভারতে সাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট পথ। ইউরোপ আমেরিকায় সাইকেলের রাস্তায় চলাচল করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। সাইকেলের রাস্তায় কোন কারণে সাইকেলের সাথে দুর্ঘটনায় আহত হলে উল্টো সাইকেলওয়ালাকেই নাকি জরিমানা প্রদান করার বিধান রয়েছে। ভারতের চন্ডীগড়ে তেমন কোন বিধান রয়েছে কিনা জানি না। তবে সাইক্লিস্ট তরুণী হেসে আমাদের কাছে পথ চাইলো। আমরা একপাশে সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিলাম।
হাঁটছিলাম আমরা। কোন তাড়া নেই। কোন তাগাদাও নেই। হেলে দুলে হাঁটছি। সাতরাজ্যের গল্প করছি। চট্টগ্রামে দুজনে কবে যে এত কথা বলেছি মনে করতে পারলাম না। এত রকমারি কথা বলার সুযোগও হয় না। গিন্নী সকাল হতেই শুরু করে মাস্টারি করতে যাওয়ার তোড়জোড়। অনেক সময় আমাকে ঘুমে রেখেই ঘরনী ঘর ছাড়ে। দিনভর কষ্ট করে বেচারি কলেজ থেকে যখন ঘরে ফিরে তখন আমি ছুটতে থাকি পথে ঘাটে মাঠে। আবার নিশুতি রাতে আমি যখন ঘরে ফিরি তখন গিন্নী দু’দণ্ড প্রেমালাপের ফুসরত থাকে না। সংসার সন্তান স্বজন চাকরি বাকরি নিয়েই সময় ছুটে চলে। এটি শুধু এক বা দুই বছরের চিত্র নয়, গত বাইশ বছর ধরে এভাবে চলছে। তাই এবারের সফরের পুরো সময়টাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি আমরা। কথায় গল্পে ছন্দে সময় অসময়ে যেন প্রাণ জাগছে। চন্ডীগড়ের মোহনীয় এই সন্ধ্যাও যেন আমাদের জীবন ভরিয়ে দিচ্ছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে রোজ গার্ডেনের গেটে পৌঁছলাম। গেটজুড়ে আলো আঁধারি। কোন পাহারাদার নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত! আমি উঁকি দিলাম। নিকটেই একজন লোকের সাথে চোখাচোখি হলো। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। আমরা আস্তে আস্তে গেট পার হয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। চমৎকার রাস্তা। বেশ চওড়া রাস্তার দু’পাশ জুড়ে সাত রাজ্যের গাছ। গোলাপ। শত শত গাছ বাগানজুড়ে। কত রকমের গোলাপ যে বাগানটিতে রয়েছে তা গুণে শেষ করা কঠিন। রাতের বেলায় তা আরো একটি বেশি কঠিন।
রোজ গার্ডেনের গেটে বিশাল একটি বিলবোর্ড রয়েছে। তাতে গার্ডেনের বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত ইংরেজীতে লিখে রাখা হয়েছে। আমি বিলবোর্ডের নিচে দাঁড়িয়ে লেখাগুলো পড়ে নিলাম। চন্ডীগড়ের ১৬ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত বাগানটি নাকি এশিয়ার বৃহত্তম বাগান। ১৯৬৭ সালে প্রায় ৪০ একরের বাগানটি গড়ে তোলা হয়। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন-এর নামানুসারে চন্ডীগড়ের এই দ্য রোজ্‌ গার্ডেন-টির নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এটির নাম দ্য জাকির হুসেন রোজ্‌ গার্ডেন। বাগানটিতে প্রায় ৮২৫টি গোলাপ এবং ৩২ হাজার ৫০০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের ঔষধি উদ্ভিদ ও গাছপালা রয়েছে। বিলবোর্ড পড়ে বাগানের গেটে কারো না থাকার বিষয়টি জানতে পারলাম। এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ভোর পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত যে কেউ বাগানটিতে প্রবেশ করে যেখানে খুশী সেখানে বসে থাকতে পারে। ঘুরতে পারে। ঘুমাতে পারে। সকালে নাকি বাগানটিতে স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন ব্যায়াম করে। হাঁটাহাঁটি করে। পুরো বাগান জুড়ে এলোমেলো রাস্তায় হাঁটাহাঁটির দারুণ এক পরিবেশ।
আমি স্ত্রীর হাতটি হাতের মাঝে নিয়ে বাগানের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। হেথায় হোথায় বসে আছে কিছু নরনারী। গাছগাছালীর ভিতর থেকেও নারী পুরুষকে বেরুতে দেখা গেল। কিছুটা আপত্তিকর লাগছিল। স্ত্রী আমার হাতটি শক্ত করে ধরে বললো, চল। ফিরে যায়। আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুরতে চাইলাম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে বেশ ভালোয় লাগছিল। গোলাপসহ নানা ফুলের সুবাসও হাওয়ায় ভুরভুর করছিল। হাসনাহেনা টাইপের গন্ধও বুঝি নাকে লাগছিল।
আমরা বাগান থেকে বেরিয়ে আসলাম। রোজ গার্ডেনের ঠিক বিপরীত পাশে মেলা বসেছে। মাইকের আওয়াজে ভেসে আসছিল জমকালো গান। আলোর নৃত্য চলছিল পুরো মেলা জুড়ে। লন্ডন আই’র আদলে বিরাট এক নাগরদোলা তৈরি করা হয়েছে। ঘুরছে। আলোর ঝলকানিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। সুউচ্চ বাউন্ডারীর ভিতরে মেলা। ছোট বেলায় আমাদের এলাকায় মেলা বসতো। নাগরদোলাও ঘুরতো। আহা, কত চড়েছি! মাথায় চক্কর দিতো। তবুও বারবার উঠতাম, বারবার চড়তাম। আহারে বাবা, কতই না জ্বালাতাম!
স্ত্রীর হাতটি আবারো হাতে নিলাম। বললাম, ‘চলো মেলায় যাই।’ কপট রাগ করে ঘরনী বললো, তোমারে আজ পেয়েছে কি! বুড়োকালে কিসের মেলা!
আমি হাত ধরে তাকে অনেকটা টানতে টানতে নিয়ে গেলাম। মেলার গেটে গিয়ে দেখি টিকেট এর বালাই নেই। যার ইচ্ছে ঢুকছে, যার ইচ্ছে বের হচ্ছে। আমরা দুজনও ধীরলয়ে মেলা অঙ্গনে ঢুকে পড়লাম।
একেবারে আমাদের মেলার আদল। সেই ছোট ছোট দোকান। সেই কাপড় ছোপড় থেকে শুরু করে মুড়ি মুরকি পর্যন্ত নানা কিছু। বাহারী সব খেলনা। থরে থরে সাজানো নানা ধরনের শুকনো খাবার। ছোলা মুড়ি ফুচকা চটপটি! আরে এতো দেখি আমাদের বাঙালি কারবার! নাকি আমরাই এদের কাছ থেকে ধার করেছি! অনেকক্ষণ ঘুরলাম। বেশ রাত অব্দি দোকানে দোকানে ঘুরলাম। হাতে হাত রেখে ঘুরছিলাম আমরা। কেউ আমাদের কিছু বলছিল না। আমরাও কারো সাথে কোন কথাবার্তা না বলে নিজেদের মতো করে জিনিসপত্র দেখে দেখে হাঁটছিলাম। ভিনদেশী এই আমাদের প্রতি কারো তেমন কোন আগ্রহ দেখা গেল না। নাগরদোলায় চড়ার খুব লোভ হচ্ছিল। ঘরনীকে রাজী করাতে পারলাম না। তাকে নিচে রেখে একা একা চড়তে ইচ্ছে করলো না। একসময় একা একা কত চড়তাম। একটা সময়ে বুঝি একা একা আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ