প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

নবী পাক (স.)’র লোমহর্ষক হিযরত যেভাবে হল

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইতিমধ্যে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ নবী পাক (স.) ও তার সঙ্গীকে খুঁজে পেতে ও বন্দী করার জন্য তাদের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের দুজনের মাথা প্রতি মূল্য ধার্য্য করে এই মর্মে ঘোষণা দেয় যে, যে কেহ ঐ দুইজনকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় তাদের কাছে উপস্থিত করতে পারলে তাকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ১ শত করে উট পুরস্কার দেয়া হবে, কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তাদের দূতগণকে বিশেষভাবে (পবিত্র) মদিনার রাস্তায় অবস্থিত গোত্র সমূহে ব্যাপকভাবে এ ঘোষণা প্রচার করার জন্য লোক প্রেরণ করে। শুধু তাই নয় এভাবে যাযাবর ও অর্ধ যাযাবররা শিকারী কুকুরগুলিকে নবী পাক (স.) ও হযরত আবু বকর (র.)’র তল্লাশিতে লেলিয়ে দেয়। বিপজ্জনক ও বেপরোয়া ব্যক্তি সুরাকা ইবন মালিক ইবন জুশুম। সুরাকা নিজে বর্ণনা করেন, কুরাইশদের প্রেরিত দূত পুত্র গোত্রের নিকট আসে এবং তাদেরকে কুরাইশদের ১০০টি উট পুরস্কারের কথা অবগত করায়। তখন ঐ গোত্রের এক ব্যক্তি ঐ স্থানে আসে এবং তাদেরকে বলে দেয় যে, সে এই মাত্র একটি ক্ষুদ্র কাফেলাকে উপকূলের দিক দিয়ে যেতে দেখেছে। সে আরও বলে যে, তার ধারণা তারাই হবেন সেই দুই ব্যক্তি। তারা ছিলেন নবী পাক (স.) ও তার সঙ্গীগণ। সুরাকা আরও বলে যে, সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল যে, ঐ ব্যক্তি নবী পাক (স.) ও তার সঙ্গীরা। কিন্তু অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করা এবং নিজে একা এ কাজটির জন্য কৃতিত্ব্ব ও পুরস্কার পাওয়ার লক্ষে সংবাদ দাতাকে বলল যে, সে যে ক্ষুদ্র কাফেলাকে দেখেছে তারা ঐ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন না। তারা ছিল অমুক অমুক ব্যক্তি যারা এই মাত্র এ স্থান ত্যাগ করে চলে গেছে। এই কথা বলে সে সময় মত কিছুক্ষণ বসে থাকে মাত্র। অতঃপর সে দ্রুত বাড়ীতে আসে। নিজের বর্শা, ধনুক ও তীর নিয়ে বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়। তার অশ্বে আরোহণ করে নবী পাক (স.) ও তাঁর কাফেলার অনুসন্ধানে দ্রুত তার অশ্বকে ধাবিত করে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে কাফেলা সত্য দৃষ্টিগোচর হয়, সে তার গতি আরও বৃদ্ধি করে। কিন্তু মহান আল্লাহ পাকের মহিমা হঠাৎ তার অশ্ব হোচট খেল, তাকে মাটিতে ফেলে দিল। তখন সে ভাগ্য পরীক্ষা করল, এতে বিরূপ দেখল। তারপরেও ভাগ্য পরীক্ষার ফলাফলকে উপেক্ষা করে সে তার অভিযান অব্যাহত রাখল এবং কাফেলার এত নিকটে আসলে সে, নবী পাক (স.)’র কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত শুনতে পেল। সুরাকা আরও বলে যে, সে লক্ষ্য করল নবী পাক (স.) ডানে, বামে, পশ্চাতে না তাকিয়ে উটের উপর শান্তভাবে বসা ছিলেন। অপরদিকে, হযরত আবু বকর (রা.) অনবরত ডানে, বামে পশ্চাত দিকে তাকাতে ছিলেন। অর্থাৎ সকল দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, যখন তিনি একজন অনুসরণকারীকে পশ্চাতে দেখতে পেলেন তখন বিচলিতভাবে তা নবী পাক (স.)’র দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং তিনি কাঁদতে ছিলেন। তা নিজের জন্য নহে, নবী পাক (স.)’র নিরাপত্তার জন্য। এতে আল্লাহর রাসূল (স.) অনুসরণকারী হতে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করলেন। হযরত আবু বকর (রা.) কে হতাশ হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন।
সুরাকা বলে যে, তৎক্ষণাৎ তার অশ্বের পদদ্বয় মাটিতে পতিত হয়ে যায় এবং সে অশ্বপৃষ্টে ঝাঁকুনি খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সে চিৎকার করে তার অশ্বকে দাঁড়াতে বলে। অনেক চেষ্টার পর মাটির ভিতর হতে অশ্বের পদদ্বয় উঠাতে সক্ষম হয়। এতে হঠাৎ একটি ধূলি ঝড় ঐ স্থান হতে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। এতে সে আবার তীরের সাহায্যে ভাগ্য পরীক্ষা করে। তাতে আবারও নিরুৎসাহ ব্যঞ্জক ফল পায়। তখন সে নবী পাক (স.) ও হযরত আবু বকর (রা.)কে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। তাদেরকে নিজের নাম বলে ও নিশ্চয়তা প্রদান করে সে তাদের কোন ক্ষতি করবে না এবং তাদেরকে থামতে ও তার কথা শুনতে অনুরোধ জানায়। এতে নবী পাক (স.)’র নিরুৎসাহ ব্যক্তি ইঙ্গিতে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহর রাসুল (স.)’র মিশন অতিসত্বর সাফল্যমন্ডিত হবে। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী হয়ে সে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে পুরস্কারের কথা অবগত করালেন। সুরাকা এও বলে তিনি এ হতে নবী পাক (স.)’র কল্যাণ কাজ করবে, তার দ্বারা কল্যাণ ছাড়া কোন ক্ষতি হবে না। সুরাকার নিজের নিরাপত্তার আবেদনে নবী পাক (স.) এক খন্ড হাড় বা চামড়ায় উল্লেখ করে দেন। সুরাকা তার বাড়িতে ফিরে আসে। সুরাকা মরিয়া হয়ে পুরস্কারের লোভে চেষ্টা অনুসন্ধান চালানো লোকজনকে নিবৃত করত।
প্রথম দিকে পবিত্র মক্কা থেকে যাত্রার দিকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেও এরপর হতে নবী পাক (স.) সচরাচর পবিত্র মদিনার সাথে ব্যবহৃত পথ ব্যবহার করেন।
উম্মে মা’বাদ (একজন কল্যাণমুখী মহিলা) বর্ণনা করেন, তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ভ্রমণকারীদেরকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করতেন। নবী পাক (স.) তাঁর শিবিরে এসে খেজুর ও গোস্ত কিনতে চাইলেন। কিন্তু ঐ সময় তাঁর নিকট কিছুই ছিল না। সে সময় ঐ এলাকায় অভাব তথা দুর্ভিক্ষ চলছিল। তার স্বামী ছাগলের পাল চরাতে বাহিরে গিয়েছিল। ঐ সময় শিবিরে নবী পাক (স.)’র দৃষ্টি পড়ল এক কোণায় একটি ছাগলের দিকে। নবী পাক (স.) ছাগলটির বিষয়ে জানতে চাইলে উম্ম মা’বাদ উত্তরে বলেন, উহা এত দুর্বল যে, উহাতে দুধ থাকতে পারে না এবং মাঠে চরানোর জন্য নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এতে নবী পাক (স.) ছাগলটিকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মে মা’বাদ তার আপত্তি নেই বললেন। নবী পাক (স.) আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করে ছাগলটির স্তন স্পর্শ করলেন। এতে ছাগলটির স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। অতঃপর তিনি একটি পাত্র নিয়ে দুধ দোহন করলেন। উপস্থিত সকলে এবং উম্মে মা’বাদ ইচ্ছামত দুধ পান করলেন। সব শেষে পান করলেন নবী পাক (স.)। অতঃপর আবার দুধ দোহন করলেন। তার স্বামী এবং তার জন্য পূর্ণ এক পাত্র দুধ রেখে দিলেন। নবী পাক (স.) সেখান হতে মদিনা মুনাওয়ারার পথে রওনা হয়ে যান। রওনা হওয়ার অল্প সময় পর শিবিরে স্বামী প্রত্যাবর্তন করেন। দুধ দেখে অবাক হয়ে যান। স্ত্রী সমস্ত ঘটনা স্বামীকে বর্ণনা করেন। শুধু তাই নয়, নবী পাক (স.) ও তাঁর চেহারার জীবন্ত বর্ণনাও করেন। এতে স্বামী খুশি মনে বললেন,তাদের মেহমান কুরাইশ বংশের সেই ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ হতে পারে না; যার ধর্ম প্রচার সম্পর্কে এত কিছু শুনা গিয়েছে। পরবর্তীতে তাঁরা মদিনা মুনাওয়ারা গমন করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
মদিনা মুনাওয়ারায় পথে আরও একাধিক কাফেলার সাথে সাক্ষাতে তাদের এত কৌতূহলী ছিল না। অপরদিকে, নবী পাক (স.) মক্কা মোকাররমা ত্যাগের কথা অতি দ্রুততার সাথে মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছে যায়। ফলে মদিনা মুনাওয়ারাবাসী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করল যে, তিনি হিযরত করে পবিত্র মদিনায় আসবেন। কুবার পার্শ্ববর্তী মুক্ত এলাকায় ময়দানে ঘুরাফেরা করতেন। রৌদ্রের তাপ অসহনীয় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর একদিন এক ইহুদির চিৎকার শুনতে পেলেন সে, তার উঁচু দালানের ছাদ হতে মরুভূমিতে বেশ দূরে এক ছোট কাফেলাকে দেখতে পাচ্ছেন। যা মদিনা মুনাওয়ারার দিকে আসতেছে। এতে মদিনা মুনাওয়ারা শহরের লোকজনের বাঁধভাঙ্গা ঢল নামে নবী পাক (স.) কে স্বাগত জানাতে। নবী পাক (স.) মদিনা মুনাওয়ারাবাসীগণকে নিয়ে শহরের উপকন্ঠে কুবাতে অবস্থান নেন। বুন আমর ইবনে আউসের অতিথি হন।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে আল্লাহর রাসূল (স.) ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তাঁর ধর্ম প্রচারের ১৪ তম বছরের ১ হিজরি/২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দ কুবাতে উপস্থিত হন। কয়েকদিনের ব্যবধানে হযরত আলী (ক.) বিশ্বস্বতার সাথে তাঁর উপর আরোপিত দায়িত ্বপালন করে সেখানে নবী পাক (স.)’র সঙ্গে মিলিত হন। পরবর্তীকালে আল্লাহর রাসূল (স.) পরিবারবর্গ ও হযরত আবু বকর ছিদ্দিকী (রা.)’র পরিবারবর্গ মিলিত হন।
বস্তুতঃ আল্লাহর রাসূল (স.)’র কুবাতে আগমনের সাথে সাথে তাঁর ধর্ম প্রচারের পবিত্র মক্কী যুগের অবসান ঘটে। তাঁর জীবনের এবং ইসলামের এক নতুন যুগের সূত্রপাত হয় পবিত্র মদিনায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধব্রাজিলে চীনা টিকার ট্রায়াল স্থগিত