প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন

নারীর প্রতি সহনশীল হোক পৃথিবী :

মহুয়া ভট্টাচার্য | বুধবার , ১১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

বিয়ে নামের সামাজিক রীতির উদ্দেশ্য দুটো মানুষ ও দুটো পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা স্থাপন এবং দুটো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের একই ছাদের নিচে বসবাসের বৈধ স্বীকৃতিও বটে। তবে আমাদের সমাজে বিয়ের এই সমস্ত প্রক্রিয়াটিতে মূলত যে সত্যটি আড়াল করে রাখা হয়, তা হলো বেশিরভাগ বৈবাহিক সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য থাকে কন্যা সন্তানটিকে পাত্রস্থ করে সামাজিক দায়মুক্ত হওয়া এবং অপরদিকে পুরুষটির জন্য একটি বৈধ সম্পর্কের সঙ্গী খুঁজে দেওয়া। এক্ষেত্রে নারীটির মানসিক কিংবা শারীরিক সক্ষমতার প্রসঙ্গ গৌণ – তা হোক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা শহুরে আত্মনির্ভরশীল নারী, বেশিরভাগই এই বৈষম্যের শিকার। এখনো আমাদের সমাজে নারী মানেই একটি জরায়ু এবং শরীরী আকর্ষণ। নারী মানেই
পুরুষের শয্যাসঙ্গী এবং তার সংসারের অসীম দায়ের অংশীদার একজন। জন্মলগ্ন থেকেই নারী এই বৈষম্যের শিকার।
বিয়ে যতটা না সামাজিক বন্ধন, তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব অর্পণ। কন্যাদায়ে নিমজ্জিত পিতার আকন্ঠ সামাজিক অনিশ্চয়তার দায় হস্তান্তর যার সদ্য বলী – চৌদ্দ বছরের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নূর নাহার। গার্মেন্টস কর্মী বাবা মায়ের মেধাবী ছাত্রী ৩৪ দিন পর্যন্ত স্বামীর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে পিতা মাতাকে দায়মুক্ত করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো চিরতরে। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামের প্রবাসী রাজীব খানের সাথে বিয়ে হয় নূর নাহারের। অপ্রাপ্ত বয়সের শারীরিক সম্পর্কের কারণে বিয়ের দিন থেকেই যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু নূর নাহারের পরিবার এবং তার স্বামীর পরিবার বিষয়টি জেনেও তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু, তার এই শারীরিক অবস্থায়ও স্বামী রাজীব খানের পাশবিকতা বন্ধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিয়ের একমাস পর স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন নূর নাহারের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা আজ কিংবা আগামী এক মাস আমাদের সংবেদনশীল মনে তোলপাড় হবে, তারপর আমরা সবাই ভুলবো। যেভাবে ভুলেছি অন্যদের।
নূর নাহার বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার। এই ঘটনার সাথে দুটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত – এক. নূর নাহারের অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে এবং দুই. তার স্বামী ও পরিবারের চরম পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। নূর নাহারের ক্ষেত্রে তার বয়স, শারীরিক অবস্থা কোন কিছুই বিবেচনা না করে তার ওপর অমানুষিক যৌন নির্যাতন করা হয়েছে, পরিমাণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। অবশ্য যেখানে গণধর্ষণের পর অপরাধী বহাল তবিয়তে এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারে, ভিকটিমকে শাসাতে পারে, সেখানে স্বামীর জোরপূর্বক শারীরিক সংসর্গের বিচারের দাবি অনেকের কাছেই হাস্যকর বটে। এর প্রধান কারণ পুরুষ তার স্ত্রীটিকে একচেটিয়া নিজের সম্পদ মনে করে। আমাদের দেশের আইনের প্রেক্ষিতেও বৈবাহিক ধর্ষণ নামের অপরাধের কোনো বর্ণনা দেওয়া হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারাগুলোর কোথাও বৈবাহিক ধর্ষণের কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের ২০১০ সালের উড়সবংঃরপ ারড়ষবহপব ( চৎবাবহঃরড়হ ধহফ ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ) অপঃ – এ ঝবীঁধষ অনঁংব এর কথা বলা হলেও তার কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা, উপাদান বর্ণনা করা হয়নি। তাহলে নূর নাহারদের কি হবে? নূর নাহার মরে গিয়ে বেঁচে গেলো এমন পাষণ্ড স্বামীর হাত থেকে। কিন্তু যারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তাদের কি হবে? তারা কার কাছে জানাবে এই কষ্টের কথা? ধর্ষকের সাথে চির সহবাস কতদিন মেনে নিতে পারবে তারা? এই করোনার সময়েও এপ্রিল মাসে দেশের ২৪ টি সংগঠন ২৭ টি জেলায় মোবাইল ফোনের একটি জরিপ প্রকাশ করে। তাতে শুধু মাত্র এপ্রিল মাসেই বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয় ৮৫ জন নারী। খুব সহজ হিসাবেই আমরা বুঝে নিতে পারি এই সংখ্যা আরো বহুগুণ বেশি। ধর্ষণকারী হিসেবে আমরা সাধারণত দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরের জোরপূর্বক শারীরিক সংসর্গ বুঝতে শিখেছি। কিন্তু তার বাইরেও যে বৈবাহিক ধর্ষণ নারী নিভৃতে মেনে নেয়, তা খোদ ভিকটিম নিজেরই অজানা থাকে কখনো কখনো।
সময় এসেছে এই বিষয়গুলোতে সচেতন হওয়ার। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যা প্রয়োজন তা হলো কিশোর বয়সেই পরিবার ও বিদ্যালয়ে যৌন শিক্ষা প্রদান। প্রয়োজন বাল্যবিবাহ রোধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংস্কার। সর্বোপরি যে বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন। নারীর প্রতি সহনশীল হোক পৃথিবী। নূর নাহারদের কৈশোরের উচ্ছ্বাস, নির্মল জীবন নিশ্চিত হোক।
লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব জ্বর করোনা নয়; তবুও চিকিৎসা ভোগান্তি
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে