দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২০ জুলাই, ২০২২ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গ্রুপ চেক-ইন করা সম্ভব হলো না। অনুরোধ করার মতোও কাউকে পেলাম না। লম্বা কিউ ধরে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আমাদের চেক-ইন করতে হলো। এতে অবশ্য আমাদের তেমন কোন অসুবিধা হলো না। রয়ে সয়ে চেক-ইন করে লাগেজ টাগেজ বুঝিয়ে দিয়ে ফ্রি হয়ে গেলাম। ফ্লাইট ছাড়ার আরো বেশ কিছুক্ষণ বাকি। এখনো যাত্রীদের ডাক পড়েনি। আমরা ডোমেস্টিক রুটের যাত্রী, তাই ইমিগ্রেশনের কোন ব্যাপার নেই। শুধু সিকিউরিটি চেক সম্পন্ন করে ফ্লাইটে চড়ে বসা। এতে করে অলস সময়টা বসে কিংবা হেলে দুলে হেঁটে কাটানো যায়। ঝিম মেরে বসে না থেকে রিল্যাক্স মুডে সামনে পা ফেলছি। হেলে দুলে হাঁটা। অনেক যাত্রী হেথায় হোথায় বসে আছেন। হাঁটছেন অনেকেই। নানা গেটের খোঁজে ছুটছেন বহু যাত্রী। বিমানবন্দরটিতে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী যেন গিজগিজ করছে!

আমরা অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। হাঁটছিলাম নিজেদের মতো করে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা সাজানো শোরুম। ইচ্ছে করলে কিছু কেনাকাটা করা যায়। যাত্রীদের অনেকেই কেনাকাটা করছেন। বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি লোকাল পণ্যও রয়েছে। হরেক কিছিমের পণ্যের পসরা থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন অনেকে। অধিকাংশ বিলাস পণ্য, চকলেট বিস্কিট এবং মিষ্টি জাতীয় পণ্যও রয়েছে। কফির দারুণ একটি পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছিল। একেবারে মনের গভীরে গিয়ে লাগছিল কফির মোলায়েম গন্ধ। চোখ বুলাতেই কফিশপ পেয়ে গেলাম। কফির গন্ধ আমাকে সেদিকেই টেনে নিচ্ছিল। সহযাত্রীদের মধ্যে কেউ কফি নিতে চান কিনা জানতে চাইলাম। সবাই মাথা নাড়লেন, নেবেন না। একটু আগে ব্রেকফাস্ট শেষে কফি খেয়েছেন, এখন আর তাদের কফি খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমি তো আমিই, কফির প্রতি বৈরাগ্য! নৈব নৈব চ! অতএব এক মগ কফি নিয়ে আদুরে চুমুক দিলাম।

যথারীতি ফ্লাইটের উড়ার ঘোষণা দেয়া হলো। আমরা ফিরে আসলাম গেটে। আনুষ্ঠানিকতা সেরে ধীরলয়ে চড়ে বসলাম বিমানে। চেক-ইন করার সময় বেশ মোলায়েম করে একটি অনুরোধ করেছিলাম। চেক-ইন কাউন্টারের তরুণীকে বলেছিলাম, সম্ভব হলে একটু সামনের দিকে সিট দেবেন প্লিজ। বেশ বিনীতভাবে কথাটি বলি আমি। বিমানযাত্রায় প্রায়শ এই অনুরোধটি করি। এমনিতেই করা। কারণ বিমানে সামনের কিংবা পেছনের সিটের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না। শুধু সিট পর্যন্ত যাওয়া আসার কষ্টটুকু ছাড়া। মোটা মানুষের পক্ষে যাত্রীদের ঠেলাঠেলি সয়ে পেছনের দিকে সিটে বসতে যাওয়াটা একটু কষ্টকর। তাই যতটুকু সম্ভব সামনের দিকে সিট দেয়ার জন্য সবসময়ই অনুরোধ করি। কেউ অনুরোধ রাখেন, কেউ রাখেন না। এই রাখা না রাখায় আমার যেমন কিছু যায় আসেনা, তেমনি চেক-ইন কাউন্টারের তরুণ কিংবা তরুণীরও কোন লাভক্ষতি হয় না। যাক, আমাদের পুরো দলটিকে সামনের দিকে সিট দেয়া হয়েছে। বেশ সামনে। মনে মনে তরুণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিজনেস ক্লাসের পরের কয়েক রো’র সিট সচরাচর ভিআইপিদের দেয়া হয়। আজ ফ্লাইটে তেমন কোন ভিআইপি আছে বলে মনে হলো না। ভিআইপি থাকলে এসব সিট আমাদের পাওয়ার কথা নয়।

আমাদের ফ্লাইট উড়াল দিয়েছে। দুই ঘন্টারও বেশি সময় আকাশে থাকবো আমরা। অতপর গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাটির নাগাল পাবো। মেঘের রাজ্যের ভিতর দিয়ে, পাশ দিয়ে এবং উপর দিয়ে আমাদের ফ্লাইটটি কেবলই উড়ছিল।

আড়াই ঘন্টা পরে গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম আমরা। গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কথা আগেই লিখেছি। এই বিমানবন্দর হয়েই আমরা চীনে এসেছি। অবশ্য বাংলাদেশ থেকে আসার সময় ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল হয়ে প্রবেশ করতে হয়েছিল আমাদের। ছিল ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা। এখন অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী হিসেবে আমরা ডোমেস্টিক টার্মিনাল হয়ে বের হবো। কোন ইমিগ্রেশন করাতে হবে না। তেমন কোন চেকও নেই, নেই পাসপোর্ট ভিসার ব্যবহার। একজন চীনা নাগরিক যেভাবে বিমান থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে বের হয়ে যেতে পারেন, এখন আমরাও ঠিক একইভাবে লাগেজটি নিয়ে বেরিয়ে যাবো।
এখানে একটু বলে রাখি। গুয়াংজুতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু মোহাম্মদ ইউছুপ আলী। ইউছুপ আলীর বাড়ি আমারই এলাকায়, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বহু বছর ধরে হংকং থাকেন। বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও ইউছুপ ভাইর সাথে আমার বন্ধুত্বটা এতটা নিবিড় যে তিনি শুধু আমাদের দুয়েকজনের সাথে দেখা করতেই হংকং থেকে বাংলাদেশে উড়ে আসতেন। আজাদী অফিসের নিচে এসে বলতেন, নেমে আসুন, কফি খাবো। অতঃপর কয়েকদিন আমরা উড়ে উড়ে বেড়াতাম। এখানে ওখানে অন্যরকমের এক উচ্ছ্বাসে আমাদের সময়গুলো কেটে যেতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রফেসর হেলাল নিজামী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনসহ ইউছুপ ভাইকে নিয়ে সময়গুলো কোনদিক দিয়ে যে পার হয়ে যেতো!

যাক, ইউছুপ ভাই আমার সাথে দেখা করার জন্য হংকং থেকে চীনের গুয়াংজু এসে অবস্থান করছেন। গুয়াংজুতে উনার বেশ বড়সড় অফিস এবং ফ্ল্যাট রয়েছে। আমি গুয়াংজু আসবো আর উনি হংকং বসে থাকবেন তা নাকি হতেই পারে না। আমার ফ্লাইট অবতরণের বহু আগেই তিনি গুয়াংজু পৌঁছে আমার প্রয়োজনীয় নানা আয়োজন সেরে রাখছিলেন। আজকের এই লেখাটিতে আমার প্রিয় বন্ধুর কথা একটু বেশিই বলবো। কারণটি একটু পরেই বলছি। অতি ভালো মানুষ আমার বন্ধুটি যে কী পরিমাণ বন্ধুবৎসল তা কাছ থেকে না মিশলে কারো বুঝার কথা নয়। বন্ধুর জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার মতো অকৃত্রিম এক উদারতার বসবাস তার ভিতরে। সাগরের মতো বিশাল এক হৃদয়ের অধিকারী আমার ইউছুপ ভাই, কী দানে কী আপ্যায়নে!

আমি হংকং গিয়েছিলাম বেশ ক’বছর আগে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় নিজের ঘরে রাখার পাশাপাশি নিজের গাড়িটিও আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার পকেটে যথেষ্ট টাকা পয়সা থাকলেও একটি টাকাও তিনি খরচ করতে দেননি, এমনকি দেশে ফেরার সময় নানা কিছু কিনে আমার ব্যাগটিও ভারি করে দিয়েছিলেন।
যাক, আমি আসছি শুনে ইউছুপ আলী ভাই প্রিয়তমা স্ত্রী শিরিন ভাবীকে নিয়ে আগেভাগে গুয়াংজু চলে আসেন। হংকং এবং চীন আলাদা রাষ্ট্র, দুই দেশের সম্পর্কও বাঘে-মোষে। চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের একটি বড় অংশ হংকং এর দিকে তাক করা বলেও প্রচারণা রয়েছে। তবে দেশ দুইটির যোগাযোগ ব্যবস্থা চমৎকার। প্রতিদিন সড়ক, নৌ, রেল এবং আকাশ পথে হাজার হাজার চীনা নাগরিক হংকং সফর করেন, আবার হংকং এর বিপুল সংখ্যক মানুষও ভ্রমণ করেন চীন।

আলাদা রাষ্ট্র হলেও ট্রেনে চড়ে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে হংকং থেকে গুয়াংজু পৌঁছা যায়। প্রায় সার্বক্ষণিক টেলিফোনে যোগাযোগ থাকার কারণে ইউছুপ ভাই আমার অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন। দুপুরে আমরা গুয়াংজু পৌঁছাবো শুনে তিনি ফোনে বললেন, এক কাজ করেন, শুধু আপনাকে নিয়ে আসলে খারাপ দেখাবে। আবার এতগুলো মানুষকে বাসায় এনেও খাওয়ানোর মতো অবস্থা গুয়াংজুতে আমার নেই। আমরা সবাই মিলে বাইরে লাঞ্চ করবো। আপনার বন্ধুদের সকলকেই লাঞ্চের দাওয়াত দিয়ে রাখেন। লায়ন ফজলে করিম ভাইর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে ওভাবেই ব্যবস্থা করি। ইউছুপ ভাইকেও একইভাবে প্রোগ্রাম দিয়ে রেখেছিলাম। বিমানবন্দরে নেমে আমরা দলবেঁধে ইউছুপ ভাইর গেস্ট হয়ে গেলাম। আমার বন্ধু আমাদের বন্ধু হয়ে গেল। মাত্র কয়েক মিনিটের কথাবার্তায়ও সবার প্রতি সবার আন্তরিকতা নয়া মাত্রা পেল। অবশ্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অনেকেই ইউছুপ আলী ভাইকে চিনেন। হংকং বসবাস করলেও তিনি মূলত বাংলাদেশে গার্মেন্টসের সাথেই ব্যবসা করেন।

কয়েকদিন ধরে চীনা খাবার খাচ্ছি। এরমধ্যে কোন কোনটির স্বাদ অসাধারণ। চমৎকার সব খাওয়া দাওয়ার মাঝেও বাংলাদেশী খাবারের জন্য পরাণ কেমন যেন হাহাকার করছিল। দেখা হওয়ার সাথে সাথে কথাটি বলতে ইউছুপ ভাই আমাদেরকে ভারতীয় একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। বেশ বড়সড় রেস্টুরেন্ট। অবশ্য, চীনে ছোট রেস্টুরেন্ট আছে বলে মনে হয় না। গত কয়েকদিনে যে ক’টি রেস্টুরেন্ট দেখেছি তার সবগুলোই বিশাল বিশাল। রেস্টুরেন্টটিতে তেমন কোন ভিড় নেই। তবুও আমাদেরকে একপাশে টেবিল জোড়া দিয়ে বসার আলাদা ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। আমাদের সকলের হাতে তুলে দেয়া হলো ম্যানুকার্ড। আমরা নিজেরা কোন অর্ডার না করে ইউছুপ আলী ভাইকে দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। সাথে লায়ন ফজলে করিম। কারণ চীনে একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে, খাবার চিনে অর্ডার দিতে পারলে চীনে বহু মজাদার খাবার রয়েছে। অর্ডার দিতে না জানলেই কপালে দুঃখ নেমে আসে। আহা, কত ধরনের খাবারের অর্ডার যে তিনি দিলেন। আমরা সবাই মিলে উৎসবের আবহে মন ভরে লাঞ্চ সারলাম।

কফি খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই লায়ন ফজলে করিম কিছুটা তাড়া দিলেন। বললেন, হোটেলে যেতে হবে। ফ্রেশ হয়ে বিকেলে ক্যান্টন টাওয়ার দেখতে যেতে হবে। পার্ল রিভারেও প্রোগ্রাম আছে। তাড়াতাড়ি করুন। আমার ব্যাপারে বেঁকে বসলেন ইউছুপ ভাই। বললেন, এখন আপনাকে আর হোটেলে থাকতে হবে না। বাসায় থাকবেন। বাসা থেকে যেখানে যাওয়ার যাবেন, ঘুরবেন, বেড়াবেন। গুয়াংজুতে আপনি হোটেলে থাকলে আমি ভীষণ কষ্ট পাবো। যে বন্ধু শুধুমাত্র বন্ধুর সাথে দেখা করতে হংকং থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন, যে বন্ধু বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য হংকং থেকে চীনে উড়ে আসেন সেই বন্ধুর ভালোবাসার গভীরতা মাপার সাধ্য আমার নেই। শুধু এটুকু বুঝি যে, এমন বন্ধুর অবাধ্য হওয়ার শক্তিও থাকে না। লায়ন ফজলে করিম ভাই অবস্থাটি বুঝলেন। বললেন, আপনি উনার সাথে চলে যান। আমরা হোটেলে যাই, পরে দেখা হবে। ইউছুপ ভাই আমাকে নিয়ে বাসায় তুললেন। গুয়াংজুর মতো ব্যয়বহুল জায়গায় বেশ চমৎকার একটি রুম পেয়ে আমি মনে মনে বর্তে গেলাম।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো। পৃথিবীর দেশে দেশে এত বেশি বন্ধু বান্ধব আমার ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছেন যে বিদেশে আমার সবকিছুই সহজ হয়ে ওঠে। দেশে দেশে কত পাতে যে আমি খাবার খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই, কত বন্ধু যে নিজের বেডরুম ছেড়ে আমাকে থাকতে দিয়েছেন তা মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়, কত বন্ধু স্বজনের ভালোবাসার কত ঋণ যে জমা পড়ে আছে তা ভাবলেই মন কাঁদে। তবে কখনো কোন বন্ধুকে নিয়ে এভাবে লিখিনি। আমার বন্ধু ইউছুপ ভাইয়ের ব্যাপারে এত কথা এই কারণে লিখলাম যে, আমার বন্ধুটি আর বেঁচে নেই। করোনাকালে হংকং এ ইন্তেকাল করেছেন। ফ্লাইট চলাচল না থাকায় তাঁর সাথে আমার শেষ দেখাটিও হয়নি। আমার বন্ধুর লাশ হংকংয়ে দাফন করা হয়েছে। আমার আপনার চেয়ে আপন হয়ে উঠা প্রিয় বন্ধুটির জন্য প্রায়শ আমার অন্তর কাঁদে, চোখে ভিজে যায় গভীর রাতে।

(চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও বিপন্ন মানবতা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন শিক্ষাভাবনা