দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

উড়ছি তো উড়ছি। থামাথামি নেই। থামার কোন সুযোগও নেই। মাঝপথে থামার অর্থ হচ্ছে জীবনই থেমে যাওয়া। রাতের ফ্লাইট। আকাশের বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ছে আমাদের এয়ারক্রাফট। এত উপর থেকে নিচের কিছু দেখার সুযোগ নেই, দেখাও যায়না। রাতের বেলা বলে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরের তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মধ্যে নিচে বহুদূরে কিছুটা আলোর ঝলক দেখা যায়। এটি নিচের কোন অচিন শহর কিংবা জনপদের অগুনতি বৈদ্যুতিক বাতির আলোচ্ছটা। হঠাৎ দেখায় মনে হয় কোথাও আলোর বান ডেকেছে। আবার কখনো মনে হয় আকাশজুড়ে ভেসে বেড়ানো মেঘমালার কোন খেয়ালীপনা। প্রকৃতি যে কিশোরীর মতো কত রূপে কতভাবে নিজেকে সাজায়! আকাশ থেকে মেঘ এবং প্রকৃতিকে বহু রূপে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ভোর কিংবা দিনে কী অসাধারণ হয়ে উঠে প্রকৃতি। দিনের কড়া সূর্যও যে ভোরে কি অনাবিল এক মায়া ছড়ায় তা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
যাক উড়ছিল আমাদের ফ্লাইট। উড়ে চলছিল। রাতের ফ্লাইট। আমাদের বডি ক্লকে রাত মানেই বিছানা, রাত মানেই ঘুম। তাই স্বাভাবিকভাবেই শরীর কিছুটা কাহিল হয়ে উঠছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঘুমানোর জন্য দারুণ আকুতি ছিল শরীরের। অক্সিজেনের অভাব শুরু হয়েছে, বার বার হাই তুলছিলাম। আমি একটি ব্ল্যাঙ্ককাট চেয়ে নিলাম। চোখ মুখ ঢেকে ঘুমানোর উদ্যোগ নিলাম। সিট হেলিয়ে দিলাম। ইকোনমি ক্লাসের সিট, বিছানার মতো হয় না, তবে কোনরকমে কাজ সারানো যায়। আমার পাশের সিটে বসেছেন লায়ন ফজলে করিম লিটন। আপাদমস্তক চীনের মানুষের মতো হয়ে যাওয়া ফজলে করিম লিটন ডিনার সারেন রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটায়। আর দশটায় নাকি উনার নাকের আওয়াজ ভাবী শুনতে পান। অর্থাৎ দশটা বাজলেই উনি আর চোখ খুলে রাখতে পারেন না। ঘুমিয়ে যান। আমাদের লায়ন্সের রাতের প্রোগ্রামগুলোতে দশটা বাজলেই উনি টেবিলে মাথা এলিয়ে দেন, ঝিম মেরে ঘুমানোর ভাব নেয়ার চেষ্টা করেন। এখানেও তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। এয়ারক্রাফট কোথায় যাচ্ছে, ঠিকঠাক পথে এগুচ্ছে কিনা, বিমানবালার মদ বিয়ার সার্ভ বন্ধ হয়েছে কিনা, তিনি এখন নন এ্যালকোহলিক যাত্রীদের চা কফি দিচ্ছেন কিনা, অন্য কোন খাবার দাবার সার্ভ করছেন কিনা এসব নিয়ে ফজলে করিম লিটনের কোন মাথাব্যাথা নেই। নেই কোন আগ্রহ। চা কফির প্রতি দারুণ আগ্রহ থাকলেও এখন আমিও ঘুমানোর উদ্যোগ নিলাম এবং ‘আশ্চর্যজনকভাবে’ অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম।
‘আশ্চর্যজনক’ বললাম এই কারনে যে সচরাচর গাড়িতে কিংবা বিমানে আমার ঘুম হয়না। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হয়। বিশেষ করে লং জার্নির ফ্লাইটগুলোতে অতি অবশ্যই আমি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সাড়ে তিন ঘন্টার ফ্লাইটে ঘুমের বড়ি খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার হয়নি, খাইওনি। তাই চীনমুখী ফ্লাইটে ঘুমিয়ে যাওয়াটা আমার কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। কাঠের চৌকির মতো একটি সিটে কী করে যে এত অবলীলায় আমি ঘুমিয়ে গেলাম কে জানে!
লায়ন ফজলে করিমের গুতোয় আমার ঘুম ভাঙলো। তিনি বললেন, উঠে পড়ুন। চলে এসেছি। নামতে হবে। আমাদের ফ্লাইট তখন দক্ষিণ চীনের গুয়াংজু বায়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উপর দিয়ে চক্কর মারছে। ব্যস্ত বিমানবন্দর। অনেক ট্রাফিক। তাই রাণওয়ে ক্লিয়ার পেতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলেও জানালেন ফজলে করিম। ব্যস্ত বিমানবন্দর? কি বলেন, গুয়াংজু আবার ব্যস্ত বিমানবন্দর হবে কেন?
আমার কথা শুনে লায়ন ফজলে করিম হাসলেন। বললেন, কি মনে হচ্ছে আপনার? ঢাকা বিমানবন্দরের মতো কোন বিমানবন্দরে নামছেন? আমি মাথা নাড়লাম, তাই তো। চীনের সাংহাই বা বেইজিং হলে নাহয় একটি কথা ছিল। গুয়াংজুতে আর কয়টি ফ্লাইট নামে! করিম ভাই হাসলেন। উনার হাসিটা বেশ রহস্যজনক মনে হলো। মুখে কিছু না বলে কেবল হাসি দিয়েই তিনি আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন। আমার ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরিই উবে গেল। আমি সিট সোজা করার সাথে সাথে নিজেও সোজা হয়ে বসলাম।
আরো মিনিট কয়েক চক্কর মারার পর আমাদের পাইলট অবতরণের ঘোষণা দিলেন। সিট বেল্ট বেঁধে ফেলার অনুরোধও করলেন। বিমানবালারা হেঁটে হেঁটে সবাই সিট বেল্ট বেঁধেছে কিনা তা পরখ করে দেখছিলেন। কাউকে কাউকে তারা নিজেরাই সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলেন, হেলান দেয়া সিট সোজা করে দিলেন। বিমান অবতরণের সময় এই কাজ দুইটি সুনিশ্চিত করেন তারা। বেল্ট বাঁধা এবং সিট সোজা করা না থাকলে কি এমন সমস্যা হবে কে জানে, তবে প্রত্যেক যাত্রাতেই বিমানবালাদের এই কাজ দুইটি করতে দেখি। তাই বিমানবালারা আসার আগেই আমি নিজে নিজে কাজ দুইটি করে রাখি। গুয়াংজুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম করলাম না। আমি অবতরণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফ্লাইট অবতরণ করলেন আমাদের পাইলট। এটি কী রাণওয়ের সুফল নাকি পাইলটের দক্ষতা তা আমি জানি না। তবে একেবারে আলতো করে আমাদের এয়ারক্রাফটটি রাণওয়ে স্পর্শ করলো এবং সামনের দিকে ছুটতে লাগলো।
বোর্ডিং ব্রিজ পার হয়ে আমরা যখন বিমানবন্দরের টার্মিনালে পা রাখলাম তখন মনে হলো আসলে এক মহাসমুদ্রে এসে পড়েছি। বিশাল এক বিমানবন্দর আমাদের যেন হাতছানি দিচ্ছিল। লায়ন ফজলে করিম এই বিমানবন্দরে অসংখ্যবার এসেছেন। তাই তিনি সবই চিনেন। পথ চেনা পথিক সাথে থাকায় আমি বেশ নির্ভার ছিলাম। ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনে। দৃষ্টি যতটুকু যাচ্ছিল ততটুকুই মনে হচ্ছিল ওয়াকওয়ে। কোথাও কোথাও চলন্ত সিঁড়ি। হাঁটছি তো হাঁটছি। ইমিগ্রেশন ডেস্ক কতদূরে কে জানে! কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, চীনের গুয়াংজুতে এত তকতকে এবং ঝকঝকে বিমানবন্দর দেখে আমি কিছুটা অবাক হচ্ছিলাম। সবকিছুই একেবারে সাজানো গোছানো। মনে হচ্ছিল যেখানে যেটি প্রয়োজন ঠিক সেখানেই সেটি রাখা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন ডেস্কে পৌঁছে আমার চোখ ছানাবড়া! সত্যি সত্যিই ছানাবড়া। এতবড় ইমিগ্রেশন ডেস্ক আমি ইংল্যান্ডের হিথ্রো কিংবা নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে দেখেছিলাম কিনা মনে করতে পারছিলাম না। শত শত ইমিগ্রেশন ডেস্ক। কোথাও কোন হুড়োহুড়ি নেই, তাড়াহুড়োও নেই। অসংখ্য ডেস্কে ইমিগ্রেশন অফিসার বসে আছেন। অধিকাংশই তরুণী। চ্যাপ্টা নাকের চীনা তরুণীদের এত সুন্দর লাগছে কেন! প্রতিটি ডেস্ক আলো করে বসে আছেন তারা!
ইমেগ্রেশন ডেস্কে বসে থাকা অফিসারদের অগাধ ক্ষমতা। পাসপোর্টে ভিসা থাকার পরও তারা চাইলে আমাকে তাদের দেশে প্রবেশ করতে না দিতে পারেন। বিশেষ করে আমেরিকার ইমিগ্রেশন অফিসারেরা তাদের এই ক্ষমতা যখন তখন প্রয়োগ করেন। বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার চীনের ইমিগ্রেশন অফিসার এই ক্ষমতার কতটুকু প্রয়োগ করবেন কে জানে! জীবনে প্রথম চীন সফরে এসেছি। দেশটির ইমিগ্রেশন সম্পর্কে খুব বেশি কোন ধারণা নেই। সাংবাদিকদের প্রতি চীনের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির নানা কাহিনী বিভিন্ন সময় শুনেছি। এতে করে আমার কপালে কি আছে তা অল্পক্ষণের মধ্যে জানতে পারবো, আপাতত বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য করিম ভাই আমার কথা শুনে প্রাণভরে হাসলেন। বললেন, ‘আপনি চীনের এত বড় এবং বিখ্যাত একটি কোম্পানির অতিথি যে আপনার পথ আটকানো সহজ না। সামনে যান।’
দেখা যাক, সামনে গেলাম।
ইমিগ্রেশন ডেস্কের তরুণীর সামনে পাসপোর্ট দিলাম। মুখে ঝুলিয়ে রাখলাম হাসি। যদি ঠিকঠাকভাবে পটানো যায় তো আর কোন সমস্যা থাকবে না। তিনি একে একে আমার পাসপোর্টের পাতাগুলো উল্টালেন। ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখলেন। কম্পিউটারে কি কি সব কাজ সারলেন, চেক করলেন। অতপর সীল মেরে পাসপোর্টটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। রূপসী তরুণীর ছোট ছোট চোখে তেমন কোন ভাবান্তর দেখলাম না, দেখলাম না অহংকারও। তিনি আমার দিকে খুব বেশি খেয়াল করেছেন বলেও মনে হলো না। একেবারে নিরস এক তরুণী! কোন অপাত্রে যে এতক্ষণ হাসি বিলুচ্ছিলাম। আমি পাসপোর্টটি হাতে নিলাম। সীল দেয়া পাতাটি দেখে নিয়ে ‘থ্যাঙ্কু’ বলে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলার বিজয় বছর ও জেসমিন খান অ্যাওয়ার্ড ২০২১
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ