দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফুরফুরে মেজাজে সময় কাটাচ্ছিলাম। বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু গোছানো হয়ে গেলে আমার মনের অবস্থা এমনিতেই ফুরফুরে হয়ে উঠে। প্রত্যাশিত কোন দেশ হলে মেজাজের উড়ুউড়ু ভাব আরো বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে নতুন কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ আমাকে হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো উজ্জীবিত করে। এবার আমি চীন যাচ্ছি। আগে কখনো দেশটিতে যাইনি। ধারে কাছের নানা দেশে গেলেও চীনে ঢোকার সুযোগ হয়নি। তাই চীন যাওয়ার জন্য আমার তর সয়ছিল না। কিন্তু কি একটি কারনে আমাদের ডেট একটু পিছিয়ে গেল। হঠাৎ করে ডেট পেছানোর ব্যাপারটি আমাকে কিছুটা চিন্তিতও করলো। আগে একবার রাশিয়া সফরের দিনক্ষণ ঠিক হলেও পরে কি কারনে পিছিয়ে গিয়ে ওই যাত্রা আর হয়নি। শুভকাজে বাঁধা পড়লে মন খচখচ করে, নানা কুডাক ডাকে। স্বচ্ছ নীল আকাশে যেন শুরু হয় মেঘের ঘনঘটা। এবারও ডেট পেছানোর পর আমার মনের ভিতরে খচখচানি বাড়তে শুরু করলো।
লায়ন ফজলে করিম ভাই বার বার আশ্বস্ত করলেন যে, কোন সমস্যা নেই। সবই ঠিক আছে। সফরের কোনকিছুতেই কোন পরিবর্তন হবে না। আমরা যেখানে যেখানে যাওয়ার কথা তার সবখানেই যাবো, সবকিছুই দেখবো। শুধু দু’দিন আগে কিংবা পরে। করিম ভাই জানালেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস মেশিনারিজ প্রস্তুতকারী চীনা প্রতিষ্ঠান ‘জ্যাক’ এর মালিকপক্ষের কারা কারা যেন থাকছেন না, এজন্য আমাদেরকে এক সপ্তাহ পরে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। যাদের দাওয়াতে যাবো তাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা না থাকলে কেমন হয়ে উঠে না! দাওয়াত দিয়ে বাড়ির মালিক না থাকার মতো!! চীনের জ্যাক কোম্পানির মালিকপক্ষের এই ভদ্রতাকে আমার বাঙালী সংস্কৃতির খুব কাছাকাছি বলে মনে হলো। চীনের সাথে বাঙালী সংস্কৃতির কোন মিল আছে কিনা কে জানে!
যাক, সময় কাটছিল। সবকিছু গুছিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। প্রতীক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। আমাদের বেলায়ও হচ্ছিল। তবে একেবারে নয়া এক আয়োজন আমাদের অপেক্ষার প্রহরকে কিছুটা মোহনীয় করলো। লায়ন ফজলে করিম চীন সফরকারী দলের প্রতিজন সদস্যকে ডিনারের দাওয়াত দিলেন। নগরীর জিইসি মোড়ে চীনা সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে উঠা একটি রেস্টুরেন্টে ডিনারের আয়োজন করা হলো। হঠাৎ ডিনার কেন? করিম ভাই খাওয়া দাওয়া করানোর পর কি সরি বলার সম্ভাবনা আছে!! কে জানে! যাক, কিছুই করার নেই। সন্ধ্যার পরপরই ডিনারে সামিল হওয়ার আহ্বান জানালেন করিম ভাই। আমাকে ডিনার সেরে অফিসে যাওয়ার পরামর্শও দিলেন তিনি। বললেন, চীনারা খুব আর্লি ডিনার করে। আমাদের সাথে চীনা দুজন অতিথিও থাকবেন। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবুও ডিনারে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সায় দিলাম। ডিনারে আমার লায়ন্স ক্লাবের সদস্য লায়ন বিজয় শেখর দাশ, লায়ন কাঞ্চন মল্লিক, লায়ন আবদুল বারেক, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শরিফুল আলম এবং চীনের জ্যাক কোম্পানির বাংলাদেশস্থ দুজন প্রতিনিধি অংশ নিলেন। চীনা স্টাইলে আলাদা একটি রুমের মধ্যে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হলো। রেস্টুরেন্টের ভিতরেই আলাদা আয়োজন, আলাদা রুম। সেখানে আপনাদের যা ইচ্ছে খান, যা ইচ্ছে করুন তা নিয়ে অন্য কারো কোন মাথা-ব্যথা থাকবে না। আপনাদের গ্রুপের বাইরে কেউ তা দেখবেও না। আমরা জম্পেশ আড্ডা দিলাম, ডিনারও সারলাম। জ্যাক কোম্পানির চীনা প্রতিনিধি আমাদেরকে বিশ্বব্যাপী তাদের কোম্পানির ব্যবসা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিলেন। লায়ন ফজলে করিম ভাই আমাদেরকে চীন সফরকালে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি এবং বৈঠকগুলোর ব্যাপারে ধারণা দিলেন। চীন সফরকালের অবশ্যই পালনীয় কিছু ট্রিপসও দিলেন। অনেকটা নতুন ছাত্রকে ছবক দেয়ার মতো করে বুঝিয়ে বলছিলেন তিনি।
নির্দিষ্ট দিনে ঘর ছাড়ার আগ দিয়ে লায়ন ফজলে করিম ফোন করলেন। বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, দেখেছেন কারবারটা? সবকিছু ফাইন্যাল করার পর লায়ন কাঞ্চন মল্লিক যেতে পারছেন না। আমার এত টাকার টিকেট, হোটেল বুকিং সবই বরবাদ হয়ে গেল! সদা হাস্যোজ্জ্বল লায়ন ফজলে করিমকে কিছুটা দুঃখিত মনে হলো। লায়ন কাঞ্চন মল্লিক আমার ক্লাবেরই সদস্য, আমাদের বন্ধু। পারিবারিক একটি অসুবিধার কারনে তিনি যেতে পারছেন না। তিনি সাথে থাকলে আমাদের সফর আরো আনন্দের হতো। আমারও কিছুটা মন খারাপ হলো।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে চীনের গুয়াংজুর পথ ধরবো আমরা। সেখান থেকে অন্যান্য স্থানে। অর্থাৎ গুয়াংজুতেই আমাদের চীনের ইমিগ্রেশন হবে। পরবর্তী সব যাত্রাই হবে অভ্যন্তরীন। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের ফ্লাইট ঢাকা অবতরনের আরো কয়েক ঘন্টা পরে চীনের ফ্লাইট উড়াল দেবে। এতে করে ঢাকায় আমাদেরকে কোথাও সময় কাটাতে হবে। লায়ন করিম ভাই হোটেল নেয়ার প্রস্তাব করলেও ঢাকার শীর্ষ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মঈনুদ্দীন তা না করে তাদের সাথে সময় কাটানোর প্রস্তাব দিলেন। এতে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে হেলাল ইউ আহমেদ কিংবা আরিফ মইনুদ্দীনের অতিথি হিসেবে ঘন্টাকয়েক সময় কাটিয়ে আবারো আমাদেরকে এয়ারপোর্টে দৌঁড়াতে হবে। হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মইনুদ্দীন দুজনই চট্টগ্রামের মানুষ। সুতরাং হোটেলের চেয়ে ওই দুই ব্যবসায়ীর সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো ভালো হবে। সেভাবেই আমাদের প্রোগ্রাম সাজানো হলো।
ডিনারে পরিচয়ের পর জেনেছিলাম যে, সফরসঙ্গী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শরিফুল আলম এবং আমার বাসা খুবই কাছাকাছি। এয়ারপোর্টে যাত্রার দিন শরিফ ভাই আমাকে ফোন করে জানালেন যে, দুইটি গাড়ি এয়ারপোর্টে নেয়ার দরকার কি? আপনি আমার সাথে চলুন। বিষয়টি আমার জন্য সুবিধাই হলো। শরিফুল ভাই আমাকে বাসা থেকে তুলে নেবেন বলেও জানালেন। বিমানবন্দরে পৌঁছার আগ দিয়ে লায়ন ফজলে করিমের আবারো ফোন। এবার যেনো কিছুটা বাড়তি উত্তেজনা। লিডার, কারবারটা দেখেছেন! বিজয় দাও এখন যাবেন না, উনি নাকি পরশু যাবেন। টিকেট চেঞ্চ করে দিতে হলো। উনি নাকি পরে গিয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হবেন।’ করিম ভাইর উত্তেজনার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে হলো। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর যাত্রার আগ দিয়ে ডেট পরিবর্তন করলে অনেকক্ষেত্রেই সমস্যা হয়। আমার ক্লাবের সদস্য লায়ন বিজয় শেখর দাশ কেন যে ডেট পরিবর্তন করলেন কে জানে! নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে।
আমরা ভালোয় ভালোয় হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। তবে লায়ন ফজলে করিম এবং আবদুল বারেক তখনো পৌঁছাননি। এতে করে আমরা বোর্ডিং না করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একসাথে বসার জন্য এই অপেক্ষা। ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। আমি শরিফুল আলম ভাইকে কফি অফার করলাম। পর্যটনের স্টলে গিয়ে কফি খেলে সময় কেটে যাবে বলেও মন্তব্য করলাম। শরিফ ভাই মুখে কিছু না বলে পা বাড়ালেন। আমিও। পর্যটনের স্টলে গিয়ে দুই কাপ কফির অর্ডার করলাম। চিনি বেশি দিলেও মোটামুটি চলে। আয়েশ করে হেলান দেয়ার আগ দিয়ে চোখ পড়লো মাথায় ক্যাপ পরিহিত করিম ভাইয়ের দিকে। পেছনে আমার মতো ভুড়িওয়ালা বারেক ভাই। কাকতালীয়ভাবে করিম ভাইর চোখও পড়লো আমার উপর। আমি ইশারায় ডাকলাম। তিনি বারেক ভাইকে নিয়ে আমাদের কাছে আসলেন। আরো দুইটি কফির অর্ডার দিলাম। করিম ভাই আবারো উত্তেজিত হয়ে বিজয় দা এবং কাঞ্চন দা কাজটি ঠিক করেন নি বলে জানালেন। বললেন, এটা কোন বাণিজ্যিক ট্যুর নয়। কোন লাভ-ক্ষতিরও নয়। আমরা সবাই দল বেঁধে মজা করতে যাচ্ছি। আর শুরুতেই আমাদের মজা নষ্ট করে দেয়া হলো। আমি করিম ভাইকে আশ্বস্ত করলাম যে, বিজয় দা তো পরশু আমাদের সাথে যোগ দেবেন। সুতরাং সমস্যা হবে না। আগুনে যেন ঘি ঢালা হলো। করিম ভাই বললেন, এই যে আমরা মজা করে কফি খাচ্ছি এটা কি আমরা একসাথে খেতে পারতাম না! আমি বুঝলাম যে বেচারি আবেগী মানুষ। আমার লায়ন্স ক্লাবের অত্যন্ত মানবিক সদস্য। সুতরাং উনাকে আর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।
আমাদের কারোরই তেমন কোন বড় লাগেজ নেই। একটি কেবিন ব্যাগ এবং অপরটিতে কিছু জামা কাপড়। শীতের কিছু কাপড়-ছোপড়ও নিতে হয়েছে। চীনে নাকি তীব্র শীত। করিম ভাই আগে ভাগে বলে দিয়েছেন, আমি গুগল থেকেও কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। সুতরাং প্রস্তুতি যতটুকু নেয়া দরকার তার সবটুকুই নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা ঢাকায় যাওয়ার জন্য বোর্ডিং করলাম। আমাদের চারজনকেই সেকেন্ড রো’র চারটি সিট দেয়া হলো। উৎসবের আমেজে গল্প করতে করতে আমাদের চীনমুখী যাত্রা শুরু হলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী
পরবর্তী নিবন্ধঅদম্য লড়াকু এক রাজনীতিক এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী