অদম্য লড়াকু এক রাজনীতিক এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | বুধবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

‘মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়’। তাই স্বপ্নবান মানুষেরাই দুঃসাহসী হয়। আর দুঃসাহসীরাই বিজয়ীর বরমাল্য পরিধান করে। স্বপ্ন-সাহস এই দুটি গুণেই মহিমান্বিত ছিলেন এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টল গৌরব, যিনি উদ্যমে ও কর্মে এক লৌহমানব। এই সিংহ-হৃদয়, অমিত-বিক্রমের অধিকারী আপোসহীনতার প্রতিকৃতি মানুষটি ধীরে ধীরে একটি জনপদের কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। আজ তাঁর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পাশাপাশি চট্টগ্রামের নাড়ি যেন তাঁর সমগ্র অস্তিত্বে বাঁধা ছিলো। যাবতীয় রক্তচক্ষু, ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেউই তাঁকে টলাতে পারেনি, একচুলও। কেননা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অভিধানে তো ‘কম্প্রোমাইজ’ বলে কোনো শব্দ নেই। আমরা এই ক্ষণজন্মা পুরুষের জীবন-কীর্তি ও সামগ্রিকতা তথা দর্শন নিয়ে যতো আলোচনা-চর্চা করবো ততোই আমরা পুষ্ট হবো। আমাদের অনাগত প্রজন্ম ইতিবাচক পথের দিশা পাবে, সমৃদ্ধ হবে।
এক মধ্যবিত্ত বনেদি পরিবারে এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর। তখন এক উত্তাল সময়, ষাটের দশক। ৬২-৬৪’র ছাত্র আন্দোলনের সেই অগ্নিগর্ভের সময়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো হাজারো তরুণের বুকে ছিলো এই মন্ত্র: ‘স্কুল কলেজ খিল/ রাস্তায় মিছিল/ কিনু গোয়ালার গলি/ হীরের টুকরো ছেলেরা আজ অশ্বমেধের বলি/ বারুদগন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফুটেছে জোসনা/ ময়লা হাতে ওকে যেন ছোসনা/ ওরে মন/ পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’।
স্বাধীনতার চেতনায় বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত নেতৃত্বে সমস্ত বাঙালি জাতি তখন অগ্নিগর্ভে। তার আঁচ এসে লেগেছে চট্টগ্রামেও। হ্যাঁ, দেশে দেশে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে তখন গণ-জাগরণ। ভিয়েতনামে চলছে আমেরিকার নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড। আমাদের দেশটাও তখন আইয়ূবশাহী সামরিক শাসনের যাঁতাকলে। মহিউদ্দিন চৌধুরীরা বরণ করে নিলেন রাজপথ। তখনকার বরেণ্য নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। মিছিলের সঙ্গী হলেন। সেই যে কিশোর বেলায় রাজপথকে সাথী করলেন, আমৃত্যু সেই মিছিলের সাহসী সৈনিকটি বজ্রমুষ্ঠি আকাশে উড্ডীন রেখেছিলেন।
এলো ৬৯। গণ-আন্দোলন। এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী তখন রাজপথের লড়াকু সৈনিক। জেল-জুলুম, হুলিয়া-মৃত্যুভয় তাঁর কাছে তুচ্ছ। ধীরে ধীরে বাঙালি জাতীয়তাবদী আন্দোলন পুষ্ট হচ্ছে। বাঙালির মধ্যে জেগে ওঠেছে স্বাধিকার চেতনা। স্বাধীনতার লক্ষ্যে পুরো জাতি এগিয়ে যাচ্ছে। মহিউদ্দিন ভাই তখন নগর ছাত্রলীগের নেতা। মুক্তিযুদ্ধের দিকে দেশকে ধাবিত করার প্রত্যয়ে সংগ্রামী চেতনায় আলোড়িত। অবশেষে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মহিউদ্দিন ভাইয়েরা হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। একাত্তরের উত্তাল সময়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের রসদ পৌঁছে দেওয়ার সময় নেভাল অ্যাভিনিউর সামনে সতীর্থ মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ ইউনুসসহ আরো কয়েকজনের সাথে গ্রেফতার হলেন পাকিস্তানি নৌ-কমান্ডারদের হাতে। নেমে এলো অকথ্য, অবর্ণনীয় নির্যাতন। পাঠানো হলো কারাগারে। পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে রেরিয়ে এলেন মহিউদ্দিন ভাই। তারপর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ‘মাউন্টেন ব্যাটেলিয়ন’ এর কমান্ডার হয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করলেন। তারপর পাকিস্তানি হায়েনাদের সাথে লড়াই করতে করতে রাঙামাটি হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করলেন। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেন।
কিন্তু মহিউদ্দিন ভাইয়ের আন্দোলন সংগ্রাম থমকে দাঁড়ায়নি। যুবলীগের রাজনীতিতে অভিষিক্ত হলেন। তারপর শ্রমিক লীগে। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে আবার রাজপথ ধারণ ও বরণ করে নিলেন বুকে। সদ্যস্বাধীন দেশকে পুনর্গঠনে ঝাঁপ দিলেন। প্রকাশ করলেন পত্রিকা ‘দৈনিক আন্দোলন’।
১৯৭৫ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের নৃশংশভাবে নিহত হওয়ার পর সমস্ত দেশ দিশেহারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দেশের এমন ক্রান্তিকালে এক অকুতোভয় তরুণ স্থির থাকতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর খুনের প্রতিশোধের স্পৃহায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক অসম যুদ্ধে। পাথেয় ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়দীপ্ত চেতনা। মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে অনুসারীদের নিয়ে মহিউদ্দিন ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঝটিকা মিছিল, গেরিলা কায়দায় বোমা বিস্ফোরণ, লিফলেট বিতরণসহ আরেক যুদ্ধ শুরু করলেন। ঘাতকদের জানান দিলেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা মরেনি। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গমন করলেন। পরিকল্পনা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মতো আবার ঘাতকচক্র নিধনের লড়াই করবেন। ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার তখন সহযোগিতা করেছিলো। কিন্তু নির্বাচনে মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসার পর সামরিক জান্তাদের সঙ্গে আঁতাত হলো। যোদ্ধাদের পুশ-ইন করা শুরু হলো। মৌলভী সৈয়দকে সেনাবাহিনী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা করা হলো। মহিউদ্দিন ভাই দেশে আসলেন, গ্রেফতার হলেন।
অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী। কোনো ক্লান্তি অবসাদ যেনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারতো না। নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এই অদম্য প্রাণ-প্রাচুর্য অর্জন কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। এছাড়া মানুষের প্রতি নিখাঁদ ও অফুরান ভালোবাসাও এই বিপুল কর্মোন্মাদনার আরো একটি উৎস। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই বন্দরনগরীর মেয়র হলেন। পরে সফল মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছের পর পর তিন বার। ন্যায়পাল হিসেবে তাঁর সাফল্য বলে শেষ করা যাবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি আমুল পরিবর্তন আনলেন, সিটি কর্পোরেশনকে তিনি ইনকাম জেনারেটিং প্রজেক্ট তৈরির মাধ্যমে সরকারের নির্ভরতা থেকে বের করে আনলেন।
এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন কর্মনিষ্ট পুরুষ। তিনি কর্ণফুলীর তলদেশে যে টানেলের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বাস্তবতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে বঙ্গবন্ধু টানেল এখন দৃশ্যমান। তাঁর সেবাপরায়ণতা কল্পনাকেও হার মানায়। হজ্বের সময় তিনি নিজের হাতে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাপড় ধুয়ে দিতেন। তাঁদের জন্য নিজের হাতে রান্না-বান্না করতেন। চট্টলবীর অভিষ্ঠায় অভিষিক্ত এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের প্রশ্নে কখনো আপোষ করতেন না। সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রকে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল লিজ দেওয়া ঠেকাতে তাঁর অনমনীয়, একরোখা আন্দোলন কোনো রক্তচক্ষু বা প্রলোভন ঠেকাতে পারেনি, তিনিই বিজয়ী হয়েছিলেন। এক কথায় এক মহাকাব্যিক চরিত্র ছিলেন এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর কায়িক উপস্থিতি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরসুরী, তারই সুযোগ্য সন্তান চট্টলগৌরব ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আমাদের সামনে রয়েছেন চট্টলার আলোকবর্তিকা হিসেবে। তিনিই মহিউদ্দিন ভাইয়ের আরাধ্য ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধ১৭-১৮ ডিসেম্বর টিআইসি-তে তির্যকের নাট্যায়োজন