দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৭ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হোটেলের রিসিপশনে বসে খোশগল্প করছিল তিন তরুণী। কী কী সব লেখালেখিও মনে হয় করছিল। আমি আড়চোখে তাদের একটু দেখলাম। তারাও তাকাল আমার দিকে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বললাম না। আমি তাদের উইশও করলাম না, হাসলামও না। তারাও থাকলো তাদের মতো করে। লবিতে বসে কয়েকজন লোক নিজেদের মতো গল্প করছে। তাদেরকে চীনা নাগরিক বলে মনে হচ্ছিল। অবশ্য চীন কোরিয়া থাইল্যান্ড হংকং তাইওয়ান কিংবা মায়ানমারের মানুষগুলোর চেহারা প্রায় একই। চেহারা দেখে এদের জাতীয়তা নিশ্চিত হওয়া খুবই কঠিন। আমি আড়াচোখে তাদেরও দেখলাম। আমার দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেদের মতো করে তারা কথা বলছে। জায়গা জমির দরদাম করছে কিনা কে জানে!

হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। চমৎকার আবহাওয়া। না ঠাণ্ডা, না গরম নাতিশীতোঞ্চ। তকতকে ঝকঝকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমি শরীরের আলস্য ভাঙ্গলাম। তাকালাম এদিকওদিক। আকাশে সুন্দর চাঁদ, তবে স্ট্রিট লাইটের আলোয় চাঁদের মহিমা মারা পড়েছে। কেমন যেনো অন্যরকমের আলো। সোডিয়াম লাইটের পরিচিত আলোয় আলোকিত চারদিক। এ আলোর উৎস কি সোলার নাকি পাওয়ার স্টেশন কে জানে! চীনে পানি থেকে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তুলনামুলক সস্তায় তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের পানি থেকে সস্তায় পাওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটির অবস্থা দিনে দিনে বেহাল হয়ে গেছে। আমরা তথাকথিত রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বানিয়ে শত কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনি। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়েও বিল দিই। কালো টাকার মালিকদের টাকার পাহাড় বানানোর সুযোগ দিই, বেগমপাড়া সমৃদ্ধ করি।

দূর! কী সব ভাবছি। চীনের রাস্তার বাতি কি পানিবিদ্যুতে জ্বলছে নাকি তেলের বিদ্যুতে জ্বলছে তাতে আমার কি যায় আসে! হাঁটতে বেরিয়েছি, দু’চার কদম হেঁটে নিরাপদে রুমে ফিরতে পারলেই হলো! এসি লো করে লম্বা একটি ঘুম দেবো, সকালে উঠে চীনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখতে যাবো! আচ্ছা সুন্দর জিনিসটা কী! আমাদের গাইড মিজ শিন চেন তো চীনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখাবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু তার চোখে মুখে দুষ্টুমী যেভাবে খেলা করেছিল তাতে আসলে কোথায় যাবো কে জানে!

আমি হাঁটছিলাম। বেইজিং শহেরর ফুটপাত ধরে হাঁটছি। ফুটপাতের পাশে আবার সাইকেলের রাস্তা। দিনভর বিস্তর সাইকেল চলাচল করলেও রাতের বেলায় তেমন সাইকেল দেখা গেলো না। তবে রাস্তায় গাড়ি চলাচল রয়েছে, সন্ধ্যার মতো বিপুল না হলেও খুব একটা কম না। বিশাল চওড়া রাস্তা। আমি কি রাস্তা পার হবো, নাকি এপার ধরে সামনে এগুবো? ওপারের ভবনগুলো বেশ বড় বড় মনে হচ্ছিল। তবে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হলাম না। আমার হোটেল যে পারে ওপাড় ধরেই হাঁটতে লাগলাম। ফুটপাত ধরে আরো লোকজন ঘরে বা অফিসে ফিরছে। মানুষে মানুষে গিজগিজ ভাবটি না থাকলেও প্রচুর মানুষ। অনেকটা দৌঁড়ের উপর তারা পথ চলছে। অনেকেই আমাকে পাশ কেটে চলে গেলো। আমাকে পেছনে ফেলে ছুটছে তারা। আহা, জীবনে কতজন কতভাবে পেছনে ফেলে গেলো!

মানুষ এবং গাড়িতে ব্যস্ত রাজপথ, ফুটপাত। রাস্তার পাশের দোকানপাটগুলোও খোলা, খোলা শপিং মলও। আমি একা একা হাঁটছি। কেউ কিছু বললো না আমাকে। জিজ্ঞেস করলো না কিছু। কোন পুলিশ টুলিশ দেখলাম না। বৈধ অবৈধ মানুষ নিয়ে তেমন কোন তোড়জোড় চীনের আছে বলে মনে হলো না!

অনেক মানুষই ছুটছে, নারী পুরুষ। একা একা অনেক নারীকে দেখলাম ঘরে কিংবা অফিসে যেতে।এত রাতে তারা অফিসে যাচ্ছে বলে এই কারণে আমার মনে হলো যে, বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনে রাতেও নাকি সমানতালে কাজ চলে, শিফটিং ডিউটি। দিনের মতো রাতেও কলকারখানা খোলা। এসব কারখানায় শুধু শ্রমিক নয়, অফিসারদেরকেও শিফটিং ডিউটি করতে হয়। কাজের চাপ বেশি হলে যা হয় আর কি! চীন কি আর এমনি এমনি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে!

কতটুক আসলাম কে জানে! পেছনে ফিরে মনে হলো আমার হোটেল থেকে বহুদূর চলে এসেছি। আরো একটু সামনে যাবো, নাকি পেছনে হোটেলমুখো যাত্রা করবো বুঝতে পারছিলাম না। আবহাওয়া চমৎকার, পরিবেশও অসাধারণ। হাঁটার জন্য দুর্দান্ত জায়গা, এমন ফুটপাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা আনন্দের সাথে হাঁটা যায়! আমি আরো কিছু পথ হাঁটলাম,আরো কিছু দোকানপাট দেখলাম। রাস্তার পাশে একটি পার্কও দেখলাম। তবে তেমন লোকজন না থাকায় সেদিকে গেলাম না।

ফিরতি পথ ধরে হাঁটছি। পথচলায় তেমন কোন পরিবর্তন আনতে হয়নি। আমি রাস্তা পার হইনি। যে ধার ধরে এগিয়েছিলাম, সেই ধার ধরেই হোটেলে ফিরছি। যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি মোড় পার হলেও আমি খুবই সচেতনভাবে কোন বাঁক নিইনি। একেবারে সোজা গেছি, এখন সোজা পিছু নিয়েছি। এভাবে হাঁটলে আমি আমার হোটেলের সামনেই পৌঁছে যাবো।

শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। কেমন উড়ুউড়ু। হাঁটাহাঁটি শরীরের জন্য বেশ ভালো। তবে রাতের হাঁটাহাঁটি শরীরটাকে বেশ হাল্কা করে দিল। রুমে ঢুকে মনে হলো, ঘুমটাও নিশ্চয় ভালো হবে।

সকালে রাজকীয় ব্রেকফাস্ট থাকলেও তা করার সুযোগ আমার নেই। ট্যুর অপারেটরের বাস চলে আসবে। তাই নাকে মুখে হালকাভাবে ব্রেড বাটার দিয়ে নাস্তা শেষ করলাম। ডিমও পেলাম। যতটুকু খেয়েছি তাতে বিলাসিতা না থাকলেও আমার প্রয়োজন মিটে গেছে। এরথেকে বেশি কিছু নাস্তায় লাগে না, ঘরে সাধারণত এটুকুও আমি খাই না। একটি ডিম এবং দুইটি হাতে তৈরি রুটির সাথে একটু সবজি। সাথে এককাপ চা। প্রাত্যহিক এই আয়োজনের বিপরীতে পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে খাবার নিয়ে যে হুলস্থুল চলে তা আসলেই বাড়াবাড়ি!

হাতে কফির মগ নিয়ে আমি রাস্তায় দাঁড়ালাম। টুকটুক করে চুমুক দিচ্ছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, নির্দিষ্ট সময়েই একটি বাস বামে ইন্ডিকেটর দিয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, আমাকে নেয়ার জন্য বাস চলে এসেছে। এই হোটেলে আমি ছাড়া তাদের আর কোন কাস্টমার নেই। শুধু একজন কাস্টমারের জন্য এতদূর আসা ঠিক লাভজনক হচ্ছে কিনা কে জানে!

দরোজা খুলে মিজ শিন চেন বাসে উঠার জন্য আমাকে তাড়া দিলেন। আমিও লাফিয়ে উঠে পড়লাম। বাস চলতে শুরু করলে গাইড মিজ শিন চেন বললেন, আমরা আরো দুইটি হোটেল থেকে ট্যুরিস্ট নেবো। তারপর আমরা আমাদের আজকের গন্তব্য চীনের গ্রেট ওয়াল দেখতে যাবো।

গ্রেটওয়াল! চমকে উঠলাম আমি। মানে চীনের মহাপ্রাচীর! বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি! আমার শরীরে কী পরিমান রোমাঞ্চ যে খেলে গেলো তা বলে বুঝানো অসম্ভব। চীনের মহাপ্রাচীর দর্শনের কথা শুনার সাথে সাথেই আমার শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো! কী বলে, বেইজিং শহরে প্রাচীর আসবে কোত্থেকে!

আমার চোখে মুখে ঘোরলাগা একটি ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠলেও সাতরাজ্যের আনন্দ খেলা করছিল শিন চেনের চোখে মুখে। আমি জানি যে তিনি অন্যান্য ট্যুরিস্ট গাইডের মতো এটিও কৃত্রিমভাবে করে রেখেছেন। কারণ তার এই হাসি, আনন্দ, দুষ্টুমী সবই মেকি। প্রতিদিন এসব দেখতে দেখতে উনার কাছে চীনের মহাপ্রাচীরের সাথে ফুটপাতের পাশের দেয়ালটির খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয়না।

বাস চলছিল, ঝিম মেরে বসে আছি আমি। চীনের মহাপ্রাচীর নিয়ে কিছু লেখাপড়া করে আসলে ভালো হতো। এমন চমৎকার একটি ট্যুর প্যাকেজ কিনে দেয়ায় লায়ন আনোয়ারুল আজীম ভাইকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। কতটাকায় প্যাকেজটি কিনেছেন কে জানে, আমাকে কিছুই জানান নি। শুধু বলে দিয়েছেন যে ওরা আপনাকে বেইজিং শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। আমার ধারণা ছিল শহরের ভিতরে ডে ট্যুরের মতো করে ঘুরাবে। কিন্তু ওরা যা করেছে তা অনন্য। বেইজিং শহরের বেশকিছু চমৎকার ট্যুরিস্ট স্পর্ট আমাকে দেখিয়েছে। এখন আবার চীনের মহাপ্রাচীর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। মহাপ্রাচীরের পথে এই বাসযাত্রা আমার সকালটাকে মনে হয় রাঙাতে শুরু করেছে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবড় যদি হতে চাও
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ