দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে ১৫ কোটি শিশু

কোভিড-১৯

ইসমত আরা জুলী | বৃহস্পতিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছরের ভয়াবহ মহামারী কোভিড- ১৯ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শিশুকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর ৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন ভয়াবহ দরিদ্রতার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এদের মধ্যে ৮৪% হতদরিদ্র শিশুর বসবাস সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে অথবা দক্ষিণ এশিয়ায় বলে সমপ্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে।এখন যা অবস্থা তার চেয়ে আগামী মাসগুলোতে দারিদ্র্যের হার আরও বৃদ্ধি পাবে। যেসব শিশুরা নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের দরিদ্রতার মধ্যে বাস করছে এদের সংখ্যা ১৫% থেকে ১২০ কোটি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এটি ইউনিসেফ ও সেইভ দা চিলড্রেন এর একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই যৌথ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, কোভিড ১৯ ও এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি আরও ১৫ কোটি শিশুকে দারিদ্র্য সীমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দারিদ্র্যে সীমায় বসবাস করার কারণ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে যার সাথে শুধু অর্থনৈতিক কারণ জড়িত নয়। একটি শিশু জীবনধারণের মূল উপাদানগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কীনা সেটা দেখার বিষয়। মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ পানি, খাবার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা ও আশ্রয়। সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোর সব শিশুরা সমানভাবে আক্রান্ত নয় তবে ওখানকার ৪০% শিশুকে চরম অভাবের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এ বছরের মহামারী বিদ্যমান অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে। মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকা ও অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা তাদেরকে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে ফেলছে। সমপ্রতি বিশ্বব্যাংক সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে যে, চরম দারিদ্র্যের সার্বিক চিত্র ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এখানে দরিদ্র শিশুদের যে সংখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি কারণ কোভিড ১৯ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আয় ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর।
ইউনিসেফ এর ডিরেক্টর অফ প্রোগ্রামস সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেন, প্রতি ৬ জন শিশুর ১ জন দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করার অর্থ হচ্ছে তারা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিমুহূর্তে সংগ্রাম করছে। তিনি আরও বলেন, এই সংখ্যাটি যে কোন মানুষকে হতাশ করার জন্য যথেষ্ট। আর মহামারী যেভাবে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা বাড়িয়েছে, তার মাত্রা ও গভীরতা এই অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত অনেক বছর ধরে দেখা না যাওয়া এ ধরনের সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হওয়া শিশু ও তাদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য স্ব স্ব দেশের সরকারকে অতি সত্ত্বর শিশু রক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। উল্লিখিত দুটি সংস্থার ডেটাতে শিশুদের ভৌগোলিক অবস্থান, তারা কোন আয়ের রেখায় অবস্থান করছে, তাদের এলাকাটি সংঘাতপূর্ণ বা ভঙুর কীনা এবং এই কারণে তারা ভয়াবহ অভাবের মধ্যে বাস করছে কীনা – এসব উঠে এসেছে। এই ডেটা ব্যবহার করে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য দূর করার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার ধাপগুলো নিরীক্ষণ করতে পারবে বলে আশা করছে। এই প্রতিবেদনে আরও দেখা যায় যে যেসকল শিশুরা ভয়াবহ দরিদ্রতার সঙ্গে বসবাস করছে তাদের জীবন বড়দের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৭ সালে প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৭.৫%শিশু যা সংখ্যায় প্রায় ৩৫ কোটি ৬০ লক্ষ, তারা এমন বাসস্থানে থাকে যেখানে পরিবারের প্রতিদিনের মোট আয় মাত্র ১.৯০ ডলার। এই হিসাবটি বড়দের ক্ষেত্রে ৭.৫%। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ক্রমানুসারে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শিশুরা এবং পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা যারা হতদরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে তারা হচ্ছে সবাই শিশু। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হচ্ছে সবচেয়ে অসহায় ও দুর্বল আর উন্নয়নশীল দেশের ৫ বছরের নীচের ২০% শিশু দরিদ্রতা সাথে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
২০১৩ সালে দারিদ্র্যেপীড়িত শিশুর সংখ্যা ১৯.৫% থেকে কমে ১৭.৫% হয়েছে।, যেটা বড়দের ক্ষেত্রে ৯.৩% থেকে কমে ৭.৫% হয়েছে। যদিও দরিদ্র শিশুর সংখ্যা সারাবিশ্বে কমে আসছে বলে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে তারপরও সাব-সাহারা অঞ্চলে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে থাকা শিশুদের সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ১৭ কোটি যা ২০১৭ সালে বেড়ে ২৩ কোটি ৪০ লক্ষ হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর শিশুরা যারা হতদরিদ্র অবস্থায় রয়েছে, তাদের মধ্যে প্রতি তিনজনের দুইজন সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে বাস করে। এই প্রতিবেদনটিতে এই কথাও যুক্ত করা হয় যে, সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়াকে যেহেতু এই বিশ্লেষণে যুক্ত করা হয়নি তাই এই সংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরও বেশি হবে।
এই মহামারীর শুরু থেকে ১৩০ কোটির বেশি শিশু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যেসব শিশুদের হাতে প্রযুক্তি ও ঘরে ব্যবহার করার অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই, তাদের শিক্ষাজীবন পুরোপুরি থমকে দাঁড়িয়েছে। স্কুলে দুপুরের খাবার থেকে তারা যে মূল পুষ্টি পেত, স্কুল বন্ধের কারণে তা থেকেও তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। সেইভ দা চিলড্রেন এর সিইও ইনগার এশিং বলেন, এই মহামারী পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য দুর্বল শিশু ও তাদের পরিবারের এ অবস্থা পুষিয়ে নেবার ক্ষমতাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তিনি আরও বলেন, যেসব শিশুরা শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়েছে তাদেরকে পরিস্থিতি শিশুশ্রম বা বাল্যবিবাহে বাধ্য করবে যার ফলে তারা একটি চক্রায়মান দরিদ্রতার মধ্যে ঘুরপাক খাবে বছরের পর বছর। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, আমরা একটা পুরো প্রজন্মের শিশুদের মহামারীর শিকার হতে দিতে পারি না। জাতীয় সরকারগুলোর ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উচিত জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে এ ক্ষতি অন্তত কিছুটা কমিয়ে আনা।
ইউনিসেফের গবেষণায় দেখা যায় যে, যেসব শিশুরা মহামারীর আগে মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল তারা এখন দারিদ্র্যের আরও গভীরতর খাদে নিপতিত হচ্ছে। শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টিকর খাবার থেকে কারণ কৃষিজাত পণ্যের বাজার বিপর্যস্ত হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে কারণ মহামারীর কারণে এ ব্যবস্থাটিকে পুরো ঢেলে সাজানো হয়েছে।
আবার বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হচ্ছে না কারণ এ ক্ষেত্রে যে বিনিয়োগ হবার কথা ছিল তা সঠিক সময়ে হচ্ছে না। এই প্রতিবেদনটিতে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে কারণ পৃথিবীর সব দেশই এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে সংগ্রাম করছে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোরে বলেছেন, কোভিড ১৯ ও এটি ছড়িেেয় পড়া ঠেকাতে গৃহীত লকডাউনের নানা পদ্ধতির কারণে লক্ষ লক্ষ শিশু নিমজ্জিত হয়েছে ভয়াবহ অভাবের গভীর খাদে। যেসব পরিবার মহামারীর আগে অভাবগ্রস্ত জীবন থেকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল, তারা আবারও নতুন করে অভাবের মুখোমুখি হয়েছে। তারা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধাপে যে চরম বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তা তাদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। উদ্বেগের বিষয় এই যে, আমরা এই সংকটের শুরুর দিকে ধাবিত হচ্ছি শেষের দিকে নয়। এই প্রতিবেদনটিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে বিভিন্ন দেশ যেন বৈশ্বিক দূর শিক্ষণকে সব শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে, খাদ্য সাহায্য ও নগদ অর্থ অভাবী শিশুদের পরিবারগুলোতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বর্ধিত করে। ফোরে আরও বলেন, আমাদের এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে শিশুদের মৌলিক অধিকার লাভ নিশ্চিত করা। যার অর্থ হচ্ছে, তারা যেন বিদ্যালয়, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি, জীবনরক্ষাকারী ঔষধ ও নিরাপদ আশ্রয় থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখা। (গ্লোবাল সিটিজেন থেকে অনূদিত)।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনে পড়ে
পরবর্তী নিবন্ধমানবতাবাদী ও জনদরদী আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু