দরিদ্র রোগীদের মাঝে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে

চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ড

| রবিবার , ২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্লোবোক্যানের সর্বশেষ একটি হিসাব পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে নতুনভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ। ওই একই সময়ে ক্যানসারে মারা গেছেন ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে বছরে যত মানুষ মারা যান, তার ৬৭ শতাংশ ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় এতো বেশি যে অনেকের পক্ষে তা জোগাড় করা কঠিন। চিকিৎসক দেখানো, পরীক্ষানিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার, ওষুধপ্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মধ্যবিত্তরাই এই খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। দরিদ্ররা খরচের ভয়ে এই চিকিৎসা নেওয়া থেকে দূরে থাকে। দরিদ্র রোগীদের নির্ভর করতে হয় সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের ওষুধের ওপর। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যানসার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডের অনেক রোগী বিনামূল্যের ওষুধ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। গত ১ এপ্রিল প্রকাশিত এই খবরে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডটি চট্টগ্রামসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ক্যান্সারের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল।

সবমিলিয়ে বেশ ক’বছর ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা সুবিধা বেড়েছে এখানে। তবে ওয়ার্ডে সেবা নিতে আসা গরিবঅসহায় রোগীরা অনেক দিন ধরে কষ্টে আছেন। প্রায় দুবছর ধরে সরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যের ওষুধ মিলছে না ক্যান্সার ওয়ার্ডে। স্টক শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে না পাওয়ায় গরিব ক্যান্সার রোগীদের বিনামূল্যের এসব ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে ওয়ার্ড সূত্র নিশ্চিত করেছে। ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা যায়, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধগুলো খুবই ব্যয়বহুল। গরিবের নাগালের বাইরে বলা চলে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বেশি দামি ওষুধ দেয়া সম্ভব না হলেও বেশ কয়টি (প্রায় দশ) আইটেম ওষুধ (ইনজেকশান) গরিব রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ওয়ার্ড থেকে সরবরাহ করা ইনজেকশানের মধ্যে ডঙোরোবিসিন, ইটোপোসাইড, সিসপ্লাটিন, ফাইভ এফ ও, ভিনক্রিস্টিন, ডাকার ভাজিন, মিথোট্রেক্সেট এবং ডসিট্যাক্সিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব ইনজেকশানের স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুবছর ধরে ওয়ার্ডের রোগীদের সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধপত্রের দাম খুব বেশি উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা খুব বেশিদিন চালানো কঠিন। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় অধিকাংশ গরিব ক্যান্সার রোগীকেই মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়। ব্যয়বহুল এ রোগের চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মন্তব্য করেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

ডিজিজস্পেসিফিক ডিসট্রেস হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড ক্যাটাস্ট্রোফিক আউটঅবপকেট এক্সপেন্ডিচার ফর হসপিটালাইজেশন ইন বাংলাদেশশীর্ষক একটি সামপ্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৬ শতাংশ পরিবার গত কয়েক বছরে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) করেছে। এ ধরনের ব্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি ক্যান্সার (৫০ শতাংশ), এরপরেই রয়েছে যকৃতের রোগ (৪৯.২ শতাংশ), এবং পক্ষাঘাত (৪৩.৬ শতাংশ)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য ব্যয়কে বিপর্যয়মূলক হিসেবে তখনই চিহ্নিত করে যখন একটি পরিবারে খাবারের চাহিদা মেটানোর পর চিকিৎসার জন্য তাদের মোট উপার্জনের ৪০ শতাংশ খরচ করতে হয়।

সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, দেশে হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের ঘটনা বাড়ছে। ২০১০ সালে ১৪,২ শতাংশ (পরিবারের মোট খরচের ১০ শতাংশ) থেকে এবং ২০১৬ সালে তা হয়েছে ২৪.৬ শতাংশ, এবং ২০২১ সালে হয়েছে ২৬.১ শতাংশ। ফলাফলে আরো দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ পরিবার হাসপাতালের খরচ মেটাতে গিয়ে দুর্দশার সম্মুখীন হয়।

আসলে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কমানোর সহজ কোনো উপায় দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিলে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা সম্ভব হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যানসার চিকিৎসার অত্যাধুনিক যন্ত্র আমদানি কর কমালে তার সুবিধা পেতে পারেন রোগীরা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দরিদ্র রোগীদের মাঝে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ। তারজন্য প্রয়োজন সরকারি বরাদ্দ। সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে ব্যয়ের উপর নির্ভরতা কমাতে সরকারের উচিত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারে বিবেচনা করা। এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রোগীদের ওষুধ সরবরাহের জন্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে