ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই অংশে বাঁধ দেওয়ার ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। কৃষি জমি ছাড়াও পানিতে তলিয়ে যায় অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি ও বিস্তীর্ণ পাহাড়।
উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম এই জলাধারের আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। তবে কাগজে–কলমে এই আয়তনের কথা বলা হলেও কাপ্তাই হ্রদের আয়তন ও গভীরতা নিয়ে গত ছয় দশকেও কোনো জরিপ করা হয়নি। দিন দিন দখল হওয়ার কারণে ছোট হয়ে আসছে হ্রদের আয়তন। কাপ্তাই হ্রদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হাট–বাজার ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার ময়লা–আবর্জনা, পয়ঃব্যবস্থাপনার গাফিলতির কারণে দূষণও বাড়ছে। দখলে ও দূষণে বিবর্ণ হচ্ছে হ্রদটি। অবশ্য দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ও উন্নয়নকর্মী মো. ওমর ফারুক আজাদীকে বলেছেন, বিগত ছয় দশকে কাপ্তাই হ্রদের দখল–দূষণ অনেক হয়েছে। এবার এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে যখন কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গিয়ে হ্রদের উঁচু এলাকা ভেসে উঠে সেখানে দখল শুরু হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন এলাকায় হ্রদ ভরাট ও দখল করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কাপ্তাই হ্রদ পরিচালনায় হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটিও রয়েছে। হ্রদে দখল–ভরাট বন্ধে হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। হ্রদ রক্ষায় প্রশাসন যদি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে তো আমরা অসহায় হয়ে যাব।
রাঙামাটি জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে চলছে হ্রদ দখলের মহোৎসব। জেলা শহরের রিজার্ভবাজার, তবলছড়ি, দক্ষিণ কালিন্দীপুর হাসপাতাল এলাকা, তবলছড়ির আর্ট কাউন্সিল কলোনিসহ সবদিকেই দখল হচ্ছে। থেমে নেই উপজেলাগুলোতেও। সেখানেও একই চিত্র। শুষ্ক মৌসুমে হ্রদ দখল ও ভরাটে সক্রিয় হয়ে ওঠে ভূমিদস্যুরা। গত চার মাস ধরে রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় মাইনীমুখে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নদী খননের বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের অভিযোগ ওঠে। পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর প্রশাসন ভরাটের কাজ বন্ধ করে দেয়। ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশকেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট এক রিট পিটিশনের ভিত্তিতে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে অবৈধ দখল, ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। রিট পিটিশনে পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়। আদালতের রিট পিটিশন নম্বর ১১৮৮৫/২০২২। হ্রদ ভরাট ও দখল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে দখল চলছে। পরিবেশবাদীরা এর জন্য স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজন রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার আজাদীকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ দখলে চারদিকে মহোৎসব শুরু হয়। কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় একটি কমিটিও রয়েছে। কিন্তু হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করা ব্যতীত হ্রদ রক্ষায় কোনো কর্মসূচি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। জেলা প্রশাসনকে কাপ্তাই হ্রদ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি ভূমি রাখতে হবে। এছাড়া যারা সচেতন মানুষ, জনপ্রতিনিধি আছেন, তাদেরও দায় রয়েছে। বিশেষ করে দেখা যাচ্ছে হ্রদ দখলের পেছনে সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালীরা জড়িত। প্রত্যেক বছর শুষ্ক মৌসুমে এমন দখল চললেও প্রশাসন কেন জানি নির্লিপ্ত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত থাকায় সাধারণ মানুষ হ্রদ দখলে উৎসাহ পাচ্ছে। হ্রদে দখল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও সেটি অমান্য করা হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটির একটা বড় সম্পদ উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, হ্রদের পানির দূষণ বাড়ার ফলে মৎস্য সম্পদ ও ব্যবহার্য পানির ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষত কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ ও বোট চলাচল করে। হ্রদ এলাকার পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়ি ও ঘনবসতি এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো নয়। সেফটিক ট্যাংকের ময়লা যাচ্ছে সরাসরি কাপ্তাই হ্রদে। এসব কারণে হ্রদের পানির মান কমছে। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক ও কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, রাঙামাটির কোথাও কাপ্তাই হ্রদ দখল করা হচ্ছে–এমন ঘটনা থাকলে আমাদের জানান। আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।