তিন দিনের নতুন হিট অ্যালার্ট

আরও তাপপ্রবাহ আসছে, এত গরম কেন, কারণ কী

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একইসাথে দিনের গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সারা দেশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গতকাল সোমবার আবারও ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র গরমের কারণে ইতোমধ্যে স্কুলকলেজে সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পাশাপাশি গরমে হিট স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর এত গরম পড়ার কারণ কী? বর্তমানে যে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে, সেটিই বা কতদিন চলবে? খবর বিবিসি বাংলার।

নতুন হিট অ্যালার্ট জারি : তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা না থাকায় সারা দেশে আবারও তিন দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চলতি মাসে এ নিয়ে টানা তৃতীয় দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করা হলো। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এই সময়ে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানানো হয়েছে। এই সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকবে। ফলে গরমের অস্বস্তি কিছুটা বাড়তে পারে।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশের কিছু জেলায় তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। এরপর গত দুই সপ্তাহে তাপপ্রবাহ প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে যশোরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া রোববার চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকায় এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বাংলাদেশে সাধারণত কোনও স্থানের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেখানে সতর্কবার্তা জারি করা হয়। আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, কোনো বিশাল এলাকা জুড়ে যখন তাপপ্রবাহ হয়, তখন এরকম সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।

এক্ষেত্রে বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে, সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরে থাকেন আবহাওয়াবিদরা। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটিকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা যদি ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।

গত দুই সপ্তাহে যশোর এবং চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। আর বর্তমানে পাবনা ও চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রাজশাহী, টাঙ্গাইল, যশোর এবং কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এর বাইরে ঢাকা, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা এবং বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

উষ্ণতম বছর : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুইতিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দুটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় ইতোমধ্যে তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।

আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেন, সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তিনি জানান, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এ বছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সারা দেশে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এছাড়া এ বছরের তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সামনে গড় তাপমাত্রা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে এটি বাংলাদেশের উষ্ণতম বছরও হতে পারে।

এর আগে ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন আবহাওয়াবিদরা। ওই বছর একটানা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলার রেকর্ড হয়েছিল।

বৃষ্টি হবে কবে? : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এ বছর এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম হচ্ছে। ফলে গরম থেকেই যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাত হলেই গরম কেটে যাবে।

কিন্তু কবে নাগাদ ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে? তিনি বলেন, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। মূলত বঙ্গোপসাগর থেকে মৌসুমী বায়ু না আসায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না বলে জানান তিনি। এ বছর মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হচ্ছে। কাজেই ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য আমাদেরকে জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতে পারে।

আগামী শুক্রবার নাগাদ দেশের কোথাও কোথাও হালকা দমকা হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে পরিমাণ কম হওয়ায় সেই বৃষ্টিপাত গরম কমানোর ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

আরও তাপপ্রবাহ আসছে : বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হওয়ায় এ বছর তাপপ্রবাহ সহসা থামবে না বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেন, সামনে আরও তাপপ্রবাহ আসছে এবং মে মাসজুড়ে সেটি চলতেই থাকবে। এছাড়া মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হওয়ায় এ বছরের তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। এমনকি তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল আগের বছরগুলোকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে এর আগে তাপপ্রবাহ একটানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। অনেকদিন ধরে তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে কোনও কোনও এলাকার বায়ুরচাপ কমে যায়, বলেন আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। বায়ুরচাপ কমলে সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প বাতাসের কোথাও জড়ো হতে শুরু করে এবং তখন সেখানে বজ্রমেঘ তৈরি হয়। পরবর্তীতে সেই মেঘ বৃষ্টিপাত ঘটায়।

এত তাপপ্রবাহের কারণ কী? : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত কয়েকদিনের পূর্বাভাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের অবস্থান। এইসব প্রদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। ওখানে বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে।

. মল্লিক বলেন, গত বছর ভারতের ওইসব অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেহেতু ওগুলো উত্তপ্ত অঞ্চল, তাই ওখানকার গরম বাতাস চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের তাপমাত্রাকে গরম করে দেয়। এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশব্যাপী এ বছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে। বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি। এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশের তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া লেগেছে।

এছাড়া বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণেও সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগরমে ধড়ফড় করতে করতে টেম্পোতেই মারা গেল যুবক
পরবর্তী নিবন্ধজব্বারের বলীখেলা, যান চলাচলে সিএমপির নির্দেশনা