তিন ‘তান্ত্রিক কবিরাজের’ কাছে ৫ কোটি টাকার সাপের বিষ

চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো উদ্ধার ব্যবহৃত হয় উচ্চমাত্রার মাদক হিসেবে যে জারে বিষ তা খুলতে লাগে বিশেষ পিস্তল

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৫ মে, ২০২২ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে কথিত তিন ‘তান্ত্রিক কবিরাজের’ হেফাজত থেকে দুই পাউন্ড কোবরা সাপের বিষ উদ্ধার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাপের বিষ উদ্ধার করা হয়েছে। এর প্রতিটি চালানে লেখা ছিল মেড ইন ফ্রান্স।
চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো উদ্ধারকৃত ফ্রান্স থেকে অবৈধ পথে আসা এসব সাপের বিষের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা, যা উচ্চমাত্রার মাদক হিসেবে অভিজাত মহলে ব্যবহৃত হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার ডিটি রোডে একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে সাপের বিষসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার তিন জন হলেন মো. ইসমাইল প্রকাশ মগা বৈদ্য (৩৫), জয়নাল আবেদিন (৫৫) ও রূপন চাকমা শ্যামল (৪২)। গ্রেপ্তারকৃতরা পরস্পরের যোগসাজশে আমদানি নিষিদ্ধ কোবরা সাপের বিষ অবৈধ পথে বাংলাদেশে নিয়ে আসে এবং বিপুল পরিমাণে অর্থ লাভের চেষ্টা চালায় বলে স্বীকার করেছে।
অভিযানে অংশ নেয়া নগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তর জোনের পরিদর্শক আরিফুর রহমান জানান, গ্রেপ্তার তিনজন নিজেদের তান্ত্রিক কবিরাজ ও মগা বৈদ্য হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাপের খেলা দেখানো, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, জিন হাজির, তাবিজ-কবজ বিক্রির নামে প্রতারণা করে থাকে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাসায় তল্লাশি করে তাদের হেফাজত থেকে একটি লাল রঙের বিশেষ জারে রাখা কোবরা সাপের তরল বিষ এবং বিভিন্ন প্রজাতির ১০ প্রাণীর রক্ত উদ্ধার করা হয়েছে। জারটির মোট ওজন এক কেজি ৩৫০ গ্রাম। এর ভেতরে ২ পাউন্ড সাপের বিষ আছে। জারটি স্বাভাবিক নিয়মে খোলা যায় না। বিশেষ পিস্তল দিয়ে জারের মুখে গুলি করে সেটি খুলতে হয়।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, জারের ওপরে লেখা আছে, ‘স্নেক পয়জন, মেড ইন ফ্রান্স’। ফ্রান্সের বিখ্যাত রেড ড্রাগন কোম্পানির উৎপাদিত আমদানি নিষিদ্ধ এসব বিষ অবৈধ পথে বাংলাদেশে আনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র জড়িত। তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ একটি চোরাচালানি চক্র সাপের বিষ বাংলাদেশে এনেছে। আমরা যাদের গ্রেপ্তার করেছি তারা এসব বিষের হেফাজতকারী মাত্র। এই তিনজনের সঙ্গে আরো দুজন আছে। তাদের উপরে আছে চক্রের সদস্যরা। কারা তাদের সাপের বিষগুলো দিয়েছে সেটা তদন্ত করে দেখছি। জব্দ সাপের বিষ পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। আমদানি নিষিদ্ধ সাপের বিষ উদ্ধারের ঘটনায় ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি পরিদর্শক আরিফুর রহমান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, বৈধভাবে এসব সাপের বিষ বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়। তবে বাংলাদেশে এসব সাপের বিষ উচ্চমাত্রার মাদক হিসেবে ব্যবহার হয়। যাদের সাধারণ মাদকে শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তারাই সাপের তরল বিষ গ্রহণ করে। দাম বেশি হওয়ায় ধনাঢ্য লোকজনই শুধু সাপের বিষ গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব সাপের বিষ বাংলাদেশে এসেছে। তাদের একটা চেইন আছে।
এর আগে ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার দক্ষিণখান থেকে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার সাপের বিষসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। একই বছর ২৫ নভেম্বর গাজীপুর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ কয়েকজনকে আটক করেছিল সিআইডি। সে বছর জুন মাসে ফেনীতে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিলো র‌্যাব। ২০১৯ সালের জুনেও ঢাকার লালবাগ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সাপের বিষসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকেই ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ; তখন এর মূল্য ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা।
এর আগে বিভিন্ন সময় সাপের বিষ উদ্ধার হয়েছে। এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে পাচারকারীরা সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিষ পাচার হয়। কখনো সেসব দেশ থেকে এনে অন্য দেশে নেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা, বছরে অন্তত ১শ কোটি টাকা মূল্যের বিষ পাচার হচ্ছে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে। ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় একাধিক চক্র গড়ে উঠেছে, যারা সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানের সাথে জড়িত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে কাঁদলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ
পরবর্তী নিবন্ধছন্দে ফিরতে চায় বাংলাদেশ