টুঙ্গিপাড়া আজ জেগেছে অনেক আগে। আজকের সকালটা ভীষণরকম আনন্দের। খুশিতে ঢেউ খেলছে ধানের গাছ,সাগরের বুক ঢেউ তুলছে নেচে নেচে। পাখিদের কণ্ঠে গান,”আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি….” বাংলার গ্রাম,শহর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দ। শীতের জামা খুলে রোদমেয়ে একটু দেরিতেই এলো। হিজল তমালের পাতার ছায়ার পাশ দিয়ে রোদমেয়ে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে। জাফরিকাটা দেয়ালের ফোকর দিয়ে আর তার উপরের কাঁচের ফাঁক গলে শীতের সকালের স্নিগ্ধতা নিয়ে রোদমেয়ে এসে তার নরোম,কোমল পরশ বুলিয়ে ডাক দিলো,
– খোকা? খোকা? আমি এসেছি। মধুমতীর পানির ছোটো ছোটো ঢেউয়ে চড়ে,বাইগারের ঘাট ছুঁয়ে, আপনার গ্রামের উষ্ণতা দিয়ে আমি এলাম আপনাকে দেখতে। আপনি কেমন আছেন বাঙলার বন্ধু?
শ্বেতপাথরের সমাধি থেকে তিনি যেনো মাথা তুললেন। সেই বজ্রকণ্ঠ একটুও বদলায়-নি।
-রোদমেয়ে? এলে? কেমন আছ তুমি? কেমন আছে আমার দেশ?
-প্রতিদিন আপনি এই প্রশ্ন করেন। সবকিছুই ভালো আছে। আর আজ তো বিশেষ দিন। কী আনন্দ আজ চারদিকে!
স্বভাবজাত স্মিত হেসে তিনি বললেন, হাসবে না? এই হাসি কী শুধু বাইরে? দেখো-লক্ষ শহীদও হাসছে! রোদমেয়ে তাকিয়ে দেখলো লক্ষ লক্ষ শহীদ বাংলার মাটিতে শুয়ে আছে। ওদের কারো মাথার খুলি উড়ে গেছে,কারো বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে গুলিতে,বেয়োনেটের খোঁচায় রক্তাক্ত শরীর। এতো কষ্ট নিয়েও ওরা হাসছে! ওরা গাইছে, আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালোবাসি….। কী দরদ দিয়ে তাঁরা গাইছেন!
রোদমেয়ের চোখ জলে ভরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ভারী স্বরে মৃদু শাসন,
কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? আজকের দিন কী কান্নার?
এত ভালোবাসা গোটা পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। এই কান্না তো খুশির। ধমক খেয়ে হেসে দিল সে। শীতের নরম কোমল সকালে রোদমেয়ের মুখটি আরো কোমল দেখাচ্ছে।
-আপনার মনে আছে ছোটোবেলায় কী ছুটোছুটি করতেন এই গ্রামে?
-শৈশব কী কেউ ভুলতে পারে? আমার বালিশা আমগাছ,হিজল তলার ঘাট,বাইগার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া সে কী ভোলা যায়? চোখের তারায় যেনো শৈশব ঝিলমিল করে উঠলো তাঁর।
হঠাৎ রোদমেয়ের মুখে হাসির ঝিলিক। কিছুটা দুষ্টুমিও কি মেশানো ছিল!
-আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজতেন। মেঠো পথের ধূলোবালি লেগে থাকতো গায়ে মুখে! কারো উপর অত্যাচার হচ্ছে দেখলেই ছুটে যেতো আপনার লেঠেল বাহিনী।
তিনিও হেসে দিলেন।
-এই গ্রাম তো আমার প্রাণ। এখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় চুপ করে থাকতে পারিনি কোনোদিন।
-বাবুই পাখির বাসা বোনা দেখতে আপনি খুব পছন্দ করতেন। তাই না?
– খুব পছন্দ করতাম। ওরা যেমন একটি একটি খড় জোড়া লাগিয়ে বাসা বানাতো,আমি ভাবতাম আমরাও এভাবে মানুষে মানুষে জোড়া লাগাতে পারি। হাতে হাত মিলিয়ে চলতে পারি।
-এই গ্রামের মাঠঘাট আপনার ভীষণ রকম প্রিয় ছিল। আপনার সঙ্গীদের নিয়ে খুঁজতেন কোথায় দোয়েল পাখির বাসা। তার সুমধুর সুর আপনাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা,ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের শিস দেয়া শেখাতেন, কথা বলা শেখাতেন। আপনার পোষা বানর,কুকুর আপনি যা বলতেন তা-ই শুনত।
-আমার সঙ্গে আমার ছোটো বোন হেলেনও এদের দেখাশোনা করত। আবার সেই স্বভাবসুলভ স্মিত হাসি।
-এই গ্রামের সবকিছুই আমার আপনজনের মতো। আমার মা’র মতো। বাবার মতো। আমার সমস্ত আত্মীয়ের মতো। একবার কী হয়েছিল জানো?
-কী! রোদমেয়ের শোনার জন্য উদগ্রীব।
-স্কুল থেকে ফেরার সময় হলে মা আমগাছের নীচে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। নজর থাকতো রাস্তার ওপর। তাঁর খোকা আসবে ওই পথে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরছি। গায়ে চাদর জড়ানো। মা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কী ব্যাপার! বললাম লোকের শতছিন্ন কাপড়চোপড় দেখে তাকে আমার গুলো দিয়ে দিয়েছি। এটা নিশ্চয় তুমি দেখেছিলে?
-বর্ষাকাল আর কিছু অল্পস্বল্প সময় ছাড়া আমি তো সবসময় থাকি। দেখেছি। আর ভেবেছি কী দয়া আপনার মনে মানুষের জন্যে। আরো কিছু এরকম ঘটনা আছে তুমি জানো না।
-আমি শুনবো। রোদমেয়ের গলায় আবদার।
-তখন বর্ষাকাল ছিল। তুমি লুকিয়েছিলে মেঘের আড়ালে। তখন গিমাডঙ্গা স্কুলে পড়তাম। ওই যে সোয়া কিলোমিটার দূরে যে স্কুলটি আছে।
রোদমেয়ে সায় দিয়ে মাথা নাড়ে। উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে জাতির পিতার প্রতি।
-স্কুল যেতে হতো খাল পার হয়ে,নৌকা করে। বৃষ্টির জলে খাল তখন পানিতে থৈথৈ করছে। হঠাৎ আমি পানিতে পড়ে যাই। শুনে আমার মা আমাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। বংশের একমাত্র নয়নের মনি আমি। সবার আদরের দুলাল।
তাঁর চোখ যেন ভেসে গেলো অনেক অনেক পেছনের এক অতীতে। তিনি যেনো দেখতে পাচ্ছেন বাবুই পাখির বাসা, গিমাডাঙ্গা স্কুল,বালিশা আমগাছ,তাঁর পোষা প্রিয় পশুপাখিগুলো, যেনো শুনতে পাচ্ছেন দোয়েল, ময়নার শিস,কথা বলা। রোদমেয়েও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাকিয়ে দেখতে লাগলো বঙ্গবন্ধুর শৈশব। নীরবতা ভাঙে রোদমেয়ে।
-ফুটবল আপনার প্রিয় খেলা ছিল।মধুমতী নদীর ওপারে চিতলমারী, মোল্লার হাট গ্রামে ফুটবল খেলতে যেতেন।
খেলার কথায় যেনো টগবগিয়ে দুরন্ত কৈশোর এসে সামনে দাঁড়ালো জাতির পিতার। কৈশোরের আবেগ এসে গ্রাস করলো তাঁর কণ্ঠ।
-গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। আমরা যখন মধুমতীর ওপারে খেলতে যেতাম, তখন আমার বাবা,চাচা,মামা ওঁরা আমাদের খেলা দেখতে যেতেন। মাঝে মাঝে বাবার টিম আর আমাদের টিমের খেলা হতো।
-আপনার বাবা,আপনার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেই গল্প করতেন। আপনি রোগা ছিলেন বলে কখনো জোরে বল মারতে গিয়ে পড়ে যেতেন। এই গল্প যখন ওঁদের শোনাতেন আশেপাশে থাকলে আপনি প্রতিবাদ করতেন। রোদমেয়ে হেসে বলে।-আর আপনার ছেলেমেয়েরা দারুণ মজা পেতো।
একটু হেসেই জাতির পিতার মুখ কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেলো।
-হামিদ স্যার আমাকে পড়াতেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। তাই বহুবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। তখনই মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল শোষিতের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। গ্রামে ছোট্ট একটি সংগঠন ছিল আমাদের। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান,টাকা, চাল যোগাড় করে সাহায্য করতাম গরিব মেধাবী ছেলেমেয়েদের। যেখানেই কোন অন্যায় দেখতাম ছুটে যেতাম, প্রতিবাদ করতাম। একবার যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের এ বাংলা গোপালগঞ্জ সফরে এলেন। স্কুল পরিদর্শন করেন। তখন আমি সাহস করে তাঁর কাছে বর্ষায় স্কুল গৃহে পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরলাম। মেরামত করার অঙ্গীকারও আদায় করে নিলাম। এভাবেই ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেলাম রাজনীতির সঙ্গে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে কতবার জেলে গিয়েছি!বারবার মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে আমাকে হয়রানি করেছিল। কারাগারে আটকে রেখেছিল।
-আপনার ভয় করেনি?
-কীসের ভয়? ন্যায়ের কথা বলছি। ন্যায়ের জন্যে লড়ছি। ভয় কীসের মেয়ে?
-জানি সব। তবুও বললাম। রোদমেয়ের ভোরের হাসিটা বেশ মিষ্টি।
-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই গণসংবর্ধনার কথা মনে পড়ে?
-কিছুই কী ভুলেছি আমার বাংলার রোদকন্যা? তখন একটার পর একটা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। কারাগারে আটকে রাখছে। কিন্তু তাতে আমার প্রতি বাংলার মানুষের ভালোবাসা আরো বেড়েছে। রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে মনু মিয়া,আসলমতিয়ুর, রুম, জহির, জোহা,
আনোয়ারের মতো সাহসীরা আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামক মিথ্যা মামলার কবল থেকে মুক্ত করে আনলো। ২৩ মার্চ ১৯৬৯। রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের ভীড়ে আমার “বঙ্গবন্ধু” নামটি ঢেউয়ের মতো দোল খাচ্ছিল। আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেখেছি কী গভীর ভালোবাসা আমার জন্যে আমার দুঃখী মানুষদের!
-টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা অনেক বড় হলেন। বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দাঁড়ালেন। তখন বাংলার মানুষের প্রাণের নেতা হলেন। যোগ করলো রোদমেয়ে। কালের সাক্ষী হয়ে আপনার বাংলার মাটিতে আলো বিলিয়ে দিতে দিতে আমি দেখেছি সব।
-ওরা ছিল আমার দুঃখী মানুষ। ছোটো বেলার অভ্যাস বড় হয়েও বদলাতে পারিনি। অধিকার আদায়ের জন্য নিজের জীবনের পরোয়া না করে পাশে দাঁড়িয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। একাত্তরের ৭ মার্চ আমি রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বললাম,
-এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার এই ভাষণের বাংলার নিপীড়িত মানুষ একযোগে আমার ডাকে সাড়া দেয়।
তাঁদের সেই প্রতিবাদী হাত নামিয়ে দেয়ার জন্যে,প্রতিবাদের কণ্ঠ থামিয়ে দেয়ার জন্যে পঁচিশ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল। যখন দেখলাম, আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে,সে- মুহূর্তে আমি আবার ডাক দিয়েছিলাম-আর নয়,মোকাবেলা করো।…বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীন করতে হবে।
-আপনার কথা সারাবিশ্ব সম্মানের সাথে স্মরণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এতো রক্ত স্বাধীনতার জন্যে আর কোথাও ঝরেনি। হায়েনারা কী শুধু রক্ত ঝরিয়েই থেমেছিল? লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছিল। কতো ত্যাগের বিনিময়ে পেলেন একটি দেশ!
-ওঁরা আমাকে বড়ো বেশি ভালোবাসতো।আমার ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হলো। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তুমি পুবাকাশে মুক্তির সংগ্রামে নিহত শহীদদের বুকের রক্ত গায়ে মেখে উদয় হলে বাংলার আকাশে।
গভীর বেদনায় রোদমেয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে বললো,
-তাই তো বাংলার মানুষ আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপনার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তারা কতো কী আয়োজন করছেন! তাঁরা আপনাকে কোনদিন ভুলবেনা। কবির কবিতায়,লেখকের লেখায়,গানের সুরে,বাংলার আকাশ- বাতাসে,দেশ-বিদেশে কোথায় নেই আপনি বঙ্গবন্ধু?
-আমি জানি ওঁরা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। এতো রক্ত ঝরিয়ে যে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নাম লেখা হলো সে দেশ তখনও শত্রুমুক্ত হয়নি বুঝতেই পারিনি। ঘাতকেরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেললো। আমার রাসেল, আমার বুকের ধন,আমার ছোট্টমণিকেও রেহাই দিল না। আমার দুই মা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলো। কী তীব্র বেদনায় ছাওয়া একটি মুখ!
কথায় কথায় শীতের সূর্য বিকেল নিয়ে এলো। রোদমেয়ের পরনের জামায় কমলা
রঙ ধরলো। আকাশ ধীরে ধীরে নামিয়ে দিচ্ছে ফিনফিনে কুয়াশার চাদর।
-কথায় কথায় কখন দিন ফুরিয়ে গেলো!
-আমার বাংলাকে তুমি আলো দিয়ে উজ্জ্বল করে রেখো।
আরো নিস্প্রভ হয়ে আসছে রোদমেয়ের মুখ। জামাটা ধীরে ধীরে কালচে রঙ ধরছে। কিছুক্ষণ পরেই পশ্চিমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। রোদমেয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ ছেড়ে যেতে যেতে বললো,
-কাল আবার আসবো, নতুন আলো নিয়ে। নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে। আমি, আপনি দু’জনেই একসঙ্গে আছি এই বাংলায়। আমি আছি আলো হয়ে, আপনি আছেন এই ভূখণ্ডের পিতা হয়ে। আমার যেমন মৃত্যু নেই, আপনিও তেমনি অমর এই বাংলায়।