তালাক বা ডিভোর্স রোধ করতে সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে

পারভীন রব্বানী | সোমবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩২ পূর্বাহ্ণ

লেবানন শিল্পী, কবি ও লেখক কাহলিল জিবরান বলেছেন,” বিচ্ছেদের আগে ভালোবাসা নিজেও এর গভীরতা বুঝতে পারে না।সত্যি কি তাই? আজকাল আধুনিক পৃথিবীতে ডিভোর্স বা তালাক বা বিচ্ছেদ একটা সহজ এবং স্বাভাবিক শব্দ । কিন্তু পুরানো দিনের ধ্যান ধারণার সাধারণ মানুষদের কাছে দাম্পত্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ অর্থাৎ এই তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর, অসম্মানজনক এবং মন ভাঙানিয়া। বিবাহ বা বিয়ে হলো একটি বৈশ্বিক সর্বজনীন সংস্কৃতি। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও এটা একটা বৈধ চুক্তি যা দুজন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত করে। এভাবেই আস্তে আস্তে সন্তান সন্ততি এবং পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এই পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে যখন বিচ্ছেদ হয়, স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হলো? এত্তো দেখাদেখি, প্রেম প্রীতি, এত্তো আয়োজন, ধূমধাম, ভালোবাসা সব ভেসে গেলো?

বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কারণে তালাক হয়। পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অভাব তো আছেই। পাশ্চাত্যে তালাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা লিভ টুগেদারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের সমাজে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে মেয়েদের একটা সম্মানজনক স্থান আছে। তাই বিয়েকে যেমন পবিত্র ও বিশ্বাসযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে তেমনি প্রয়োজন বোধে তালাক বা ডিভোর্সেরও সুন্দর সুযোগ করে দিয়েছে। দুজন স্বামী স্ত্রী যখন সংসারের ভালোবাসা এবং মধুর সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে, জীবনের প্রতি ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যায়, ধৈর্য সহ্য, সমঝোতা, বোঝাপড়া সব যখন একেবারে খাদের কিনারে এসে ঠেকে তখনই তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে দুজনেই কম বেশী ভুক্তভোগী হলেও সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের সন্তানেরা। অনেকে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসাবে হীনস্মন্যতায় ভুগে যা তাদের সুস্থ মানসিক গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের সমাজে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তালাকের জন্য নারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তখন এই সব নারীরা একটা ট্রমার মধ্যে চলে যায়, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল যারা। পুরুষরা দোষী হলেও তাদের সব মাফ হয়ে যায়।

তালাক বা ডিভোর্সের কারণ হিসাবে নিম্নবিত্তের যৌতুক প্রথাই প্রধান। তবে বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ,অযথা নারীদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, পরকীয়া,মাদকাসক্তি ইত্যাদিও কারণ হিসাবে আছে।

মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজে স্বামী স্ত্রীর অসহিষ্ণু মনোভাব, সন্দেহপ্রবণতা, ভুল বোঝাবুঝি, আর আজকাল পরকীয়া প্রেম প্রাধান্য পাচ্ছে। দুজনের ইগো সমস্যা তো আছেই। মানসিক বিকারগস্ত কিছু পুরুষ শিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্ত্রীদের উপর স্বামীত্ব ফলাতে গিয়ে পরিণামে তালাকের কাছেই সমর্পিত হয়। শুধু স্বামী স্ত্রীর কারণে নয়, অনেক সময় পরিবারের কিছু সদস্যের অসহযোগিতা, ষড়যন্ত্রের শিকার এই বিচ্ছেদ। আমাদের দাদী, নানী কিংবা উনাদের পূর্ব পুরুষেরা অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ রূপে পুরুষদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাই কখনো কখনো মুখ বুজে অত্যাচার, অনাচার সহ্য করে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ভুলেও বিচ্ছেদ বা তালাকের কথা ভাবতেন না। একই ছাদের নীচে থেকেও অনেক সময় স্বামী স্ত্রীর দুর্বল সম্পর্ক টিকে থাকে কেবলমাত্র সন্তান এবং সমাজের কথা ভেবে।

কিন্ত আজকাল মেয়েরা আত্মনির্ভরশীল। শিক্ষা দীক্ষা, চাল চলনে অনেক পুরুষের চেয়ে অগ্রগামী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পোস্টে আসীন। স্বামীর অবহেলা বা অত্যাচার অত সহজে মেনে নিবেনই বা কেন? তাই এ ক্ষেত্রে তালাকও এগিয়ে আছে। দুটো ভিন্ন পরিবারের দুটো মানুষের পছন্দ অপছন্দ, ইচ্ছাঅনিচ্ছা, চাওয়াপাওয়া, স্বপ্ন কখনোই এক হতে পারে না। কিন্ত যখনই বিয়ে নামক একটা মিষ্টি বন্ধনে জড়িয়ে পড়বে, তখনই দুপক্ষের কিছুটা ছাড়, সমঝোতা, সর্বোপরি সহমর্মিতার হাত এগিয়ে দিতে হবে। তবেই পরিবারের বন্ধন হবে দৃঢ়। বিচ্ছেদের চিন্তা কখনোই মাথায় আসবে না। ভালোবাসার হবে জয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা : ‘তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সেই জানে তোমাকে ভোলা কি কঠিন।’

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষায় শিশুর আগ্রহ বাড়াতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : লেখক ও সাহিত্যিক