তারাগুলো ঝরে যায়

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২১ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:১০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের আকাশ থেকে একে একে তারাগুলো খসে পড়ছে, ঝরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এরকম হলে আমরা তো দিক্‌ভ্রান্ত হয়ে যাবো। যেই ধ্রুবতারা আমাদের পথ-নির্দেশনা দিবে, সেই তারাই যদি ঝরে পড়ে, তাহলে আমাদের উপায় হবে কী? মনের গভীরে চিন্‌চিনে একটা ব্যথা, বুকের মাঝে একটা শূন্যতা, ভাষায় বুঝাতে না পারার বেদনা। হঠাৎ করে বোধোদয় হয়, তিনি চলে গেলেন। আর কখনও দেখা হবে না। যখনই দেখা হতো, উনার উপস্থিতির কারণেই, একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, একটা ভিন্ন আবহ সৃষ্টি হতো।

সপ্তাহ দুই-তিনেক আগেই, বাল্যকালের অনেক প্রিয়বন্ধু ডা. জিয়া করিমের সঙ্গে টলিডোর এক রেস্টুরেন্টে বসে কথা হচ্ছিলো। সে ইন্ডিয়ানার ইভান্সভিল থেকে মিশিগানের এন্‌-আরবারে যাচ্ছে বড় মেয়ে ডাঃ আমানীকে দেখতে। সঙ্গে রয়েছে, ভাবী- ডাঃ সোমা, আর ছোটমেয়ে রানীম। তারা মাঝপথে জুম্মা পড়ার প্ল্যান করে আমাদের শহরেই ব্রেক নিয়েছে, আমাকেও আগে থাকতেই জানিয়ে। সকলে জুম্মা পড়ে, একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে করতে কথা বলছিলাম।

সপ্তাহখানেক হলো, জিয়া বাংলাদেশ থেকে ফেরত এসেছে, একটা বড়সড় পূণ্যের কাজ সেরে। চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালের নতুন ভবনে, শ্রদ্ধেয়া চাচী (জিয়ার আম্মা), ডাঃ সাহিদা করিমের নামে ‘অব্‌স্‌ এন্ড গাইনী’ ওয়ার্ডের উদ্বোধন করে এসেছে। জিয়া ভাগ্যবান, কতবড় একটা মহৎ কাজ করেছে। সে আসলেই ভাগ্য- এই ওয়ার্ড শুরুই করেছিলেন শ্রদ্ধেয়া চাচী; এখন নতুন ভবনে আরো বড় করে শুরু হলো। জিয়া আরো ভাগ্যবান, এসময়ে তার সঙ্গে ছিলেন শ্রদ্ধেয় চাচা ডাঃ এ এস এম ফজলুল করিম সাহেব। উনিই তো প্রধান চালিকাশক্তি। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সেই হাসপাতাল তো শুরুই হয়েছিলো চাচার হাত দিয়ে। সেই শুরু থেকে আজীবন উনিই তো এটার সঙ্গে জড়িত এবং বর্তমানের উন্নতমানের একটা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার সিংহভাগ কৃতিত্বও তো চাচারই। তিনিই সেই ধ্রুবতারা, যাকে আমরা হারালাম এই কিছুদিন আগে।

জিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব সেই ছোট্টক্লাস থেকেই,- ’৭০-এর দশকের শুরুতেই। দ’ুজনেই সেন্ট প্ল্যাসিড্‌স্‌ স্কুলে পড়তাম; এরপরে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। ক্যাডেট কলেজের পরে সে ডাক্তার হলো, আমি গেলাম মেরিনে। এখনো মনে পড়ে, ছোট্টবেলায় শুক্রবারে জুম্মা নামাজ পড়তাম লাভ লেইনের মাদানী মসজিদে। সেখানে জিয়া করিমও তার আব্বার সাথে আসতো। তখন তাদের বাসা ছিলো, লেডিস-ক্লাবের উল্টাদিকে, চিটাগাং ক্লাব আর ইস্পাহানী বিল্ডিং-এর মাঝে। চাচাকে দেখতাম কি সুন্দর সুপুরুষ, লম্বা-চওড়া, এবং কি ভীষণ ব্যক্তিত্ব! দূর থেকে দেখে মনে সম্‌ভ্রম এবং অন্যরকমের এক অনুভূতি জাগতো। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সকলের জন্যে উদার ও ভালবাসায় ভরা প্রাণ। উনি সবসময়ই নিজের অনন্য ব্যক্তিত্ব, ডিগনিটি এবং মানুষের প্রতি স্নেহ-মমতা দুটাই বজায় রেখেছিলেন। জিয়াও সবসময়ই চাচার মতই সুদর্শন এবং সকলেরই প্রিয়।

সাম্প্রতিককালেও চাচাকে দেখেছি সেই একইরকম। সাত-আট বছর আগে খুলশীর বাসায় চাচীকে দেখতে গিয়েছিলাম। বাসায় অনেক কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও, চাচা নিজহাতে আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। আর, চাচীর সম্পূর্ণ পরিচর্যা তো নিজেই করছিলেন। আবারো, বছর দুয়েক আগেও চাচার সঙ্গে দেখা হলো, জিয়ার বোন সুমাইয়ার বাসা ওহাইহোর এক্রোনে। চাচা তখন বয়সের ভারে অনেক নুয়ে পড়েছেন, কিছুদিন আগেই প্রস্টেটের অপারেশান হয়েছিলো। কিন্তু ওনার সেই ব্যক্তিত্ব, ডিগিনিটি এবং অমায়িকতার কোনো অভাব ছিলো না। আমাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করলেন, লাঞ্চ করলেন। আমার নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিলো সেদিন।

ভাবি দুনিয়াতে ওনার কতশত অবদান! সমাজে একজন ডাক্তার মানেই মানি লোক। এটাই তো যে কোনো মানুষের জন্য একটা অনেক কৃতিত্বের ব্যাপার; কষ্টের অর্জন। কিন্তু চাচা শুধু ডাক্তার বা সার্জন হিসাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য নন, তিনি মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রথিতযশা প্রফেসর। একজন মানুষ জীবনে কতটা ভালো হলে একই সঙ্গে এই দুইয়ের সমন্বয় হয়, সেটা চাচার জীবন দেখেই বুঝা যায়। ডাক্তার হিসাবে তিনি কতশত হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছেন, তাদের আরোগ্য করেছেন নিশ্চয়ই তারা ওনার জন্যে প্রাণভরে দোয়া করেছে। তারপরে রয়েছে হাজারে হাজারে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, যারা ওনার থেকে শিক্ষালাভ করেছে। সকলেই আজ স্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। এর পিছনে চাচার অবদান অতুলনীয়। আমার দুই ভাই ডাক্তার, জিয়াসহ আরো কত বন্ধু ডাক্তার, জিয়ার বউ সোমা ডাক্তার এরা সকলেই চাচার ছাত্র-ছাত্রী। শুধু তো দেশে নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকা সারাবিশ্বে উনার ছাত্ররা ছড়িয়ে আছে। তাদের কৃতিত্বের পিছনে চাচার অবদান অনস্বীকার্য।

শুধু প্রফেশানাল দিকটা দেখলাম। অথচ চাচার মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে উনার সমাজসেবায় ও জনহিতকর কর্মকান্ডে। ডাক্তারী ও শিক্ষকতার বাইরে চাচা-চাচী নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য-সেবার উন্নতিতে। বিশেষ করে আমাদের সমাজব্যবস্থায় সবচাইতে অবহেলিত- মা এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্যে উনাদের অবদান অপরিসীম। তারই ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল। চাচা-চাচীর হাতেগড়া এই প্রতিষ্ঠান, উনারা এর পিছে জীবনের সবকিছু ঢেলে দিয়েছিলেন। আমার আব্বা-আম্মাও এর সাথে জড়িত ছিলেন; এবং আমাদের পুরা পরিবারই। কিন্তু এই হাসপাতালের সিংহভাগ কাজই তো করেছেন চাচা। চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিস, কিডনি ফাউন্ডেশান আরো অনেক জনকল্যাণকর কর্মকান্ডে উনি জড়িত ছিলেন। ছিলেন রোটারিয়ান, এবং ‘সার্ভ এবোভ সেলফ’ পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।

আমি জাহাজে যাওয়ার পরে জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে। ১৯৯৬ সালে আবার দেখা নিউ-ইয়র্কে। এরপর দুইজনেই অ্যামেরিকা থাকার সুবাদে প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হয়। সম্প্রতি তার বড়মেয়ে মিশিগানে, আমার বাসার কাছেই রেসিডেন্সি শুরু করায় ভালই হয়েছে। যদিও, আমার নিজের কাজের জন্যে আমি নিজেই বাসায় থাকি না। তাই জিয়ারা আসলে, মাঝে মাঝেই মিস করি। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যখন আসলো, সৌভাগ্যবশতঃ আমি বাসায়, এবং জুম্মা পড়লাম একসাথে।

আমি জিয়াকে চাচার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ধরেই নিয়েছিলাম, মাত্র কয়েকদিন আগে দেশে এত্তবড় অনুষ্ঠান করে চাচীর নামে ওয়ার্ড খুলে, চাচা নিশ্চয়ই খুবই কাহিল থাকবেন এবং দেশেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিন্তু জিয়া জানালো, না ওর সঙ্গেই এসেছেন; এবং কানেক্টিকাটে ছোটভাই ইয়াসিরের বাসায় আছেন। আমি তখনো আল্লাহ্‌র এতবড় পুরস্কারের কথা চিন্তাই করি নাই। এখন চিন্তা করে দেখলাম-আল্লাহ্‌ উনাকে হাতে ধরে সৌভাগ্য দিয়েছেন, আজীবন মানুষের সেবা করলেন। মৃত্যুর পাঁচ সপ্তাহ আগে নিজের স্ত্রীকে এত্তবড় সম্মানের স্থানে তুলে ধরলেন। তারপরে কষ্ট করে হলেও অ্যামেরিকায় চলে আসলেন যেখানে উনার তিন ছেলেমেয়েই আছে। সবশেষে ছেলেমেয়েদের সুযোগ করে দিলেন উনার অন্তিম-সেবা করার। এরকম সৌভাগ্য কয়জনের হয়? উনি যদি দেশে থেকে যেতেন, তাহলে তো জিয়া-সুমাইয়া-ইয়াসিরের পক্ষে সম্ভব হতো না জীবনের শেষক্ষণে পাশে থেকে ওনার সেবা করার। ইয়াসির তাই করতে পেরেছে। আল্লাহ্‌ না দিলে কেউ কি এরকমভাবে নিয়ামত পাবে? ছোটছেলের হাতে কলেমা পড়তে পড়তে চলে গেলেন। আল্লাহ্‌ শুধুমাত্র নেককার মানুষদেরই এরকম দিয়ে থাকেন।

আজ আমি ভাবছি, আমাদের আকাশ থেকে একে একে তারাগুলো ঝরে পড়ছে। আমরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছি। চাচার চিরবিদায় কী শুধু উনার পরিবারের জন্যই ক্ষতি? না, এই হারানোর ক্ষতি সকলেরই- আমরা যারা উনাকে দেখেছি, উনাকে চিনি, আমরা তো এরকম রোল-মডেল আর পাবো না। এই ক্ষতি তো পরিবার ছাড়িয়ে, মেডিক্যাল-কমিউনিটির সকলের ক্ষতি; সমগ্র চট্টগ্রামের জন্যে এটা একটা বিশাল ক্ষতি, যা কখনই পূরণ হওয়ার নয়। আমি মন থেকে চাচার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। নিশ্চয়ই উনার সকল সৎকর্ম, সদকা-জারিয়ার বিনিময় উনি চিরকাল পেতে থাকবেন।

refayet@yahoo.com
টলিডো, ওহাইও, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারুল ও অন্ধকার
পরবর্তী নিবন্ধচিটাগাং উইম্যান চেম্বারের বিশ্ব নারী উদ্যোক্তা দিবস উদযাপন