ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাতমাস দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সম্প্রতি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এ-বছর না নিয়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার গ্রেডের ভিত্তিতে ‘অটোপাস’ দিয়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। আমার মতে সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত অবিমৃষ্যকারী ও অদূরদর্শী, তাই সময় থাকতেই এই ‘তোগলকী সিদ্ধান্ত’ বাতিল করে পরীক্ষা-গ্রহণ পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করার জন্যে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার ছেলে-মেয়ে বা নিকট-আত্মীয় কেউ এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী না থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রায় তের-চৌদ্দ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর মারাত্মক ভবিষ্যত পরিণতির কথা ভেবে একজন শিক্ষকের প্রাণ কাঁদছে বিধায় এই অনুরোধটি জানাচ্ছি।
আমার নিজের ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা-কাটছাঁট ও সেশান-বিলম্বের শিকার হয়েছিলাম। ওখান থেকে আমার নিজের ক্যারিয়ারে যে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম সেটার বর্ণনা দিলে পাঠকরা ব্যাপারটির ভয়াবহ তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবেন আশা করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু আমাদের সহপাঠি ছিলেন তাই তিনিও আমার এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার ভুক্তভোগী ছিলেন। সেজন্যে আশা করি অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয়টি তিনিও উপলব্ধি করে এই ভুল সিদ্ধান্তটি থেকে সরে আসবেন। যখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম তখন সেশান নিয়ে প্রথমবার স্বৈরাচারী আইউব শাহীর ‘তোগলকী সিদ্ধান্তের’ শিকার হয়েছিলাম । ১৯৬০ সালের জানুয়ারী থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত আঠারো মাস আমাদেরকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তে হয়েছিল শরীফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশান পরিবর্তনের সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে। কিন্তু, ১৯৬১ সালেই আইউব খানের মত আবার পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ায় জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশানে ফেরত আসার জন্যে আমাদেরকে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয়মাস করে আঠারো মাস। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে আমরা অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে আবার আগের নিয়মে ফেরত এসেছিলাম। ঐ শরীফ কমিশন ও তদ্‌পরবর্তী হামুদুর রহমান কমিশনের আরো অনেক ‘তোগলকী সুপারিশ’ বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ ১৯৬২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে ‘শিক্ষা আন্দোলন’ গড়ে তোলায় আইউব শাহীর ‘তোগলকী শিক্ষা-সংস্কারের’ এসব তোড়জোর ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রী যারা ডিগ্রির তৃতীয় বর্ষে পড়ছিল তারা বিনা পরীক্ষায় ‘অটোপাস’ পেয়ে বিএ/বিএসসি/বিকম ডিগ্রি অর্জন করে প্রথমে খুশীতে ডগমগ হলেও পরবর্তী ক্যারিয়ারের পদে পদে তাদেরকে ঐ অটোপাসের জন্যে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল।
এরপর আমাদের দ্বিতীয়বার সেশান-বিলম্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আমি। অর্থনীতি অনার্স পরীক্ষা প্রায় ছয়মাস পিছিয়ে গিয়েছিল ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে এনএসএফ এর মাস্তান ‘পাসপাত্ত’ু হত্যার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে খুলে দেওয়া মাত্রই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায়। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের যে অনার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল সেটা অনিবার্যভাবে শুরু হলো ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে। অনার্সের লিখিত আট পেপারের মধ্যে ছয় পেপারের পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে শুরু হলো দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। অতএব, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বাকি দুই পেপারের লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা না নিয়েই ১৯৭২ সালে ঐ ছয় পেপারের মার্কসের ভিত্তিতে অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয়েছিল আমাদের, ফার্স্ট ক্লাস মিস করেছিলাম আমি। যাক্‌, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ায় ঐ ক্ষতি হয়তো কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যেখানে আমাদের মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোবার কথা ঐ রেজাল্ট বেরিয়েছিল ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে, দেড়-বছরের বেশি বিলম্বে। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, দেড় বছর আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে মাস্টার্স শেষ পর্বের ক্লাস ও পরীক্ষা ঠিকমত সম্পন্ন হওয়াতেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ক্যারিয়ার সফল হয়েছিল অনার্স পরীক্ষার অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও। (১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে বিনা-পরীক্ষায় একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ‘অটোপাস’ ছিনিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু ঐ ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেককেই কর্মজীবনে এর জন্যে পস্তাতে দেখেছি।)
নিজের এই অভিজ্ঞতাটুকু বর্ণনা করছি পরীক্ষার গুরুত্বটা তুলে ধরার জন্যে। এইচএসসি ‘অটোপাস’ যারা পেতে যাচ্ছে তারা এই পর্যায়ে খুশি হলেও পরবর্তী জীবনে পদে পদে তাদেরকেও হেনস্থা হতে হবে , এটুকু সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সময় এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে স্ট্যান্ড করার আলাদা মর্যাদা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষার যে কঠিন প্রতিযোগিতা, আমি কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় আমাকে ঐ ভর্তি পরীক্ষাই দিতে হয়নি। এখন এইচএসসি পরীক্ষার যে গ্রেডিং সিস্টেম সেটা আংশিক বিবেচিত হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্র্তির যোগ্যতা নির্ধারণে, বাকিটা লিখিত ভর্তি-পরীক্ষার স্কোরের ভিত্তিতে। অটোপাসের গ্রেডকে কি আদৌ এভাবে বিবেচনা করা হবে? বুয়েট, অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি– প্রতিটি ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্সে’ ভর্তি প্রক্রিয়াকে কি নানাবিধ জটিলতায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে না এই অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে? করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সাত মাস ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু, এদেশে সেশান-বিলম্ব তো অতীতে আরো ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল! বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তিন বছর থেকে সাড়ে তিন বছরের সেশান-জ্যামের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু, গত এক দশকে ঐ সেশান-জ্যাম প্রায় দূর করা গেছে। এবারও যদি আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা করে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় তাহলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে রেজাল্ট ঘোষণা খুবই সম্ভবপর। এর ফলে, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে পরবর্তী দু’বছরের মধ্যেই তাদের সেশান-জট দূরীকরণে তেমন বেগ পেতে হবে না।
ভুলে যাওয়া যাবে না, ক্যারিয়ার-চয়েসের দৃষ্টিকোণ থেকে এদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা এইচএসসি পরীক্ষা। অতএব, পিএসসি বা জেএসসি পরীক্ষার সাথে এইচএসসি পরীক্ষাকে একই দৃষ্টিতে দেখা মারাত্মক ভুল। করোনা মহামারির কারণে এ-বছর পিএসসি বা জেএসসি পরীক্ষা নিতে না পারলে তেমন বেশি ভোগান্তি হবে না ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত উচ্চতর শিক্ষার চয়েস-নির্ধারণে। কিন্তু, এইচএসসি পরীক্ষায় ‘অটোপাস’ ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত জীবনকে মারাত্মক প্রতিবন্ধিতার মুখোমুখি করে দেবে। এখনো আমাদের হাতে সময় আছে ভ্রম-সংশোধনের। বিশ্বের অনেক দেশে করোনা ভাইরাস মহামারির বিপদ সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, অক্টোবর মাস থেকে পাকিস্তানেও স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। তাই, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলেও নভেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য মনে করছি এজন্যে যে বর্তমান সিদ্ধান্তটি অনেক বেশি অবিমৃষ্যকারী মনে হচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যথাযোগ্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে প্রতি পরীক্ষা-কক্ষে অন্যান্য বছরের অর্ধেক পরীক্ষার্থীর আসনের ব্যবস্থা করা যায়। পরীক্ষা-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবỊত কলেজগুলোর সাথে আশেপাশের হাই স্কুলগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষা-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রবেশকারী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের হাত ধোয়ার কড়াকড়ি কঠোরভাবে পালন করা যায়। কেন্দ্রের আশেপাশে অবস্থিত কম্যুনিটি সেন্টারগুলো ভাড়া করে পরীক্ষা কেন্দ্রের অতিরিক্ত আসনের সংকুলান করা যায়। অতিরিক্ত পরিদর্শক হিসেবে এলাকার সকল কলেজের শিক্ষকদেরকে ইনভিজিলেশান-ডিউটি বন্টন করে দেওয়া যায়। পরীক্ষার খাতা সংগ্রহ করার পর সেনিটাইজার স্প্রে করে ওগুলোকে ভাইরাস-মুক্ত করা যায়। এমনকি, সকল পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরকে মাস্কের সাথে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে হ্যান্ড-গ্লাভসও পরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। মূল দাবি হলো, পরীক্ষা নিতেই হবে। অনেক বিলম্ব হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এখনো ‘ডেমেজ-কন্ট্রোল’ এর সেরা উপায় পরীক্ষা-গ্রহণ। ‘অটোপাস’ এক্ষেত্রে কোন ভাল সমাধান হতেই পারে না।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা