ড.মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতেই হবে
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, তারপর থেকে আমদানি ব্যয়ের দ্রুতবর্ধমান ধারার কারণে গত দশ মাসে রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমে গেছে। ২০২২ সালের জুন মাসের শেষে রিজার্ভ কত দাঁড়িয়েছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক এই রিজার্ভ ৪১.৬ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে থাকবে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের ‘রিফাইনেন্সিং স্কীমের’ অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রফতানিকারকদেরকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৪.১ বিলিয়ন ডলার। সরকার যে তথ্যটা জনগণ থেকে লুকাতে চাচ্ছে তাহলো, এই সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেহেতু ঋণগ্রহীতা রফতানিকারকরা ঐ ইডিএফ ঋণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় তাঁদের রফতানি আয় ঋণদানকারী ব্যাংকে ফেরত দিচ্ছেন না তাই প্রায় সব ব্যাংকেই ঐ ইডিএফ লোন ‘ফোর্সড লোনে’ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এই ইডিএফ লোন মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে/যাচ্ছে। (ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ফোর্সড লোনের কিছু ভয়াবহ তথ্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে)। পুঁজিপাচারের এহেন সহজ হাতিয়ার আমাদের সরকার কর্তৃক দেশের পুঁজিপাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার কাহিনী দেশবাসীদেরকে জানানো আমাদের কর্তব্য মনে করি।
রফতানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণের ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করা যাক্‌। ইডিএফ এর ঋণ দেওয়া হয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে। রফতানিকারকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও এক্সসরিজ আমদানির এল/সি এর বিপরীতে এই ঋণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশীয় ব্যাংকের সাথে বিদেশী ব্যাংকের লেনদেনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা। রফতানী পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পাওয়া গেলে ঐ ঋণগ্রহীতা তাঁর দেশীয় ব্যাংকে সুদাসলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দেওয়ার কথা। ফেরত পেলে তারপর ঐ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রায় ঐ ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত দেবে, ওটাই নিয়ম। এই প্রক্রিয়া ঠিকমত কাজ করলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের রিজার্ভ ইডিএফ ঋণের কারণে না কমারই কথা! পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সর্বোচ্চ ২৭০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়সীমার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত না আসলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঐ বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামে ঋণটাকে ‘ফোর্সড লোনে’ পরিণত করে। ফলে, দেশীয় টাকায় ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আসলেও বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত আসবে না। অভিযোগ রয়েছে যে আমাদের দেশের রফতানিকারকদের বৃহদংশই তাঁদের রফতানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ দেশে ফেরত আনছেন না। তাঁরা এই বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশের ব্যাংকে জমা রেখে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘরবাড়ী, ব্যবসাপাতি, এপার্টমেন্ট কিনছেন। বেগমসাহেবা এবং পরিবারের সদস্যরা বিদেশের সেই ঘরবাড়ীতে বসবাস করছেন, ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করছে, সাহেবও কিছুদিন পরপর বিদেশের বাড়ীতে বেড়িয়ে আসছেন। ঈদুল ফিতর-কোরবানীর ঈদে সবাই দেশে এসে উৎসবে শরীক হচ্ছেন, আত্মীয়-স্বজনদের বিয়েশাদীতে অংশ নিচ্ছেন। এভাবেই গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইতালী, ফ্রান্স, দুবাই এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশী পুঁজিপাচারকারীদের রমরমা বসতিগুলো। কানাডার টরোন্টোর বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের ‘সেকেন্ড হোম’ এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ‘বাংলাদেশী ফ্রেটারনিটি’ এভাবেই বহুলপরিচিতি অর্জন করেছে। টরোন্টোর কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেনি, কোন এলাকার নামও ‘বেগমপাড়া’ দেওয়া হয়নি। (ভারতের ‘বেগমপুরা’ নামের একটি ডক্যুমেন্টারি থেকে নামটা নেয়া হয়েছে)। ঐ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের পুঁজিপাচারকারীরা বাজার দামের চাইতে অনেক বেশি দামে ঘরবাড়ী কিনে বেগমসাহেবাসহ তাঁদের পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করে চলেছেন। এর ফলে টরোন্টোর রিয়াল এস্টেটের বাজারে হু হু করে মূল্যস্ফীতি ঘটে চলেছে। মিডিয়ায় এই ইস্যু নিয়ে হৈ চৈ শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কানাডা সরকারের নানা এজেন্সি থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে পাচার করা অর্থের ব্যাপারে, টরোন্টোর বাংলাদেশী কম্যুনিটির পক্ষ থেকেও এই পুঁজিপাচারকারীদের বিরুদ্ধে নাকি প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
টরোন্টোর বেগমপাড়ায় বাংলাদেশের রফতানিকারকরা দেশের আমদানিকারক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং রাজনীতিবিদদেরকে টপকে সবচেয়ে বড় মালিকগোষ্ঠির দাবিদার হতে পারে বলে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে গত তিন দশকে। রফতানিতে আন্ডারইনভয়েসিং এদেশের বহুলপ্রচলিত সমস্যা। এর সাথে রয়েছে রফতানিকারকরা তাঁদের রফতানি আয়ের একাংশ বিদেশে রেখে দেওয়ার পুরানো সমস্যা। খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে যে যেসব রফতানিকারক এই দুটো পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার করছেন কিংবা তাঁদের রফতানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফেরত আনছেন না তাঁরাই বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ইডিএফ এর লোন বাগিয়ে নিচ্ছেন। ঐ লোনের অর্থও যে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? অতএব, কার্‌ মাথা থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এভাবে ‘রিফাইনেন্সিং স্কীমের’ অধীনে ঋণ হিসেবে ইডিএফ লোন দেওয়ার মতলবটা বেরিয়ে এসেছিল তা জানা প্রয়োজন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এর মাধ্যমে দেশ থেকে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা যে বিদেশে পাচার হয়ে গেলো তার দায়ভার তো শেষ বিচারে তাঁকেই নিতে হবে!
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে ঋণ না দেওয়ার জন্য আমি বহুদিন ধরে সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রবল স্ফীতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো প্রণোদিত করেছে ইডিএফ কর্মসূচি শুরু করতে। কেউ কেউ বলেছেন বর্তমানে রিজার্ভ যেভাবে জমা রাখা হয় তাতে ওখান থেকে নাম-কা-ওয়াস্তে সুদ পাওয়া যায়, ঋণ দিলে তার চাইতে বেশি সুদ পাওয়া যাবে। এহেন ভুয়া যুক্তি দিয়ে হয়তো তাঁর সম্মতি আদায় করা গেছে! এখন ২০২২ সালে যখন বাণিজ্য ঘাটতির বেলাগাম বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় রিজার্ভের দ্রুত-পতন শুরু হয়েছে তাতে অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে যাচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছয়’শ আশি বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। কিন্তু, সেখানে তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে বা কোন গোষ্ঠিকে ঋণ দেওয়ার দাবি উঠছে না! আমাদের দেশে রিজার্ভ চল্লিশ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পরই রিজার্ভ থেকে দেশে-বিদেশে ঋণ প্রদানের জন্য আমাদের সরকারের নীতি-প্রণেতারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন? বিপদের দিনে অর্থনীতিতে যাতে কোন বিপর্যয় নেমে না আসে তার রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সেজন্যই রিজার্ভের বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অর্থনীতির জন্য আস্থা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ‘প্যানিক’ সৃষ্টি হয়েছিল, একথা আমরা ভুলে গেলাম কেন?
বর্তমান চৌত্রিশ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অনেকের কাছে এখনো স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়ংকর মূল্যস্ফীতি সংকট ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ সম্পর্কে উৎকন্ঠা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। (কিছু কিছু প্রাইভেট সেক্টরের ঋণগ্রহীতাদের আইএফসি থেকে কিংবা অন্যান্য সূত্র থেকে বিদেশী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘গ্যারান্টর’ হওয়ার ব্যাপারটাও শেষমেশ দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে)! ইতোমধ্যেই আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, এসব পদক্ষেপের সম্মিলিত প্রভাবে আমদানি ব্যয় খুব বেশি কমবে না, তাই এসব পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও আগামী অর্থ-বছরে দেশের আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ করা যাচ্ছে কিনা কিংবা থামানো যাচ্ছে কিনা সেটাই আমাদের নীতি-প্রণেতাদের জন্য ‘এসিড টেস্ট’ হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, চাল ও নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির যে আগুন লেগেছে সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে সহজে নিভবে না, জাহাজভাড়ার উল্লম্ফনও থামবে না। এর সাথে অচিরেই যোগ হতে যাচ্ছে বিশ্বমন্দা। মন্দার কারণে যদি আমাদের পোষাক রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায় কিংবা থেমে যায় তাহলে অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে। অতএব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দিতে হবে। ২০২২ সালের ৩০ জুন তারিখে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের মোট রফতানি আয় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো সত্ত্বেও অর্থ-বছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ২০২১-২২ অর্থ-বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। ৪ জুলাই ২০২২ তারিখের দি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত খবর মোতাবেক আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে ১৭.৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে এত বড় ঘাটতি স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। বরং, গত দুই দশক ধরে (গুটি কয়েক বছর ব্যতিরেকে) দেশের লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে উদ্বৃত্ত থাকাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ২০০১ সালে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল সেখান থেকে গত দুই দশকে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল।
কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ উপদেশ দিচ্ছেন ‘প্যানিক’ না করার জন্য, আমি তাতে আশ্বস্ত হতে পারছি না। কারণ, আমাদের নীতি-প্রণেতারা প্রায় এক দশক ধরে যেভাবে বেপরোয়া ‘উন্নয়ন আফিমের’ মৌতাতে মশগুল হয়ে রয়েছেন সেটা আমার মনে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এদেশের বড়-ছোট সকল প্রকল্পের ব্যয় বিশ্বে তুলনামূলকভাবে সর্বাধিক প্রমাণিত হচ্ছে। নানাবিধ সমালোচনা সত্ত্বেও আরো অনেকগুলো মেগা-প্রজেক্টের সমীক্ষা এগিয়ে চলেছে, যেন ব্যাপারটি নিয়ে জেদাজেদির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে! কিন্তু, আমরা কিভাবে ভুলব যে প্রকল্প মানেই এদেশে পুঁজিলুন্ঠনের মওকা সৃষ্টি? এবারের বাজেটে চলমান মেগা-প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন অব্যাহত রেখে নতুন কোন মেগা-প্রকল্প শুরু না করার সিদ্ধান্তকে সেজন্যই সময়োপযোগী মনে করি। এই পর্যায়ে আমাদের অর্থনৈতিক নীতি-প্রণেতাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত চৌত্রিশ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভকে আগামী বছর আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনা। তাহলেই অর্থনীতিতে আবার স্বস্তি ফিরে আসবে। আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয়ের যে স্ফীতি ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে সরকারের তেমন কিছু করার নেই, কিন্তু কম প্রয়োজনীয় আমদানির আইটেম সাময়িকভাবে কাটছাঁট করে কিংবা শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করতেই হবে। সরকার অবশ্য ইতোমধ্যেই বিপদের আশংকায় আইএমএফ এর কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য আবেদন করেছে। কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো এই ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু, আইএমএফ এর ঋণ ভাল সমাধান নয়। কারণ, এর সাথে অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যেগুলো দেশের অর্থনৈতিক নীতি-গ্রহণের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে। বাংলাদেশ এবার ১২ বছর পর আইএমএফ এর ঋণের মুখাপেক্ষী হতে যাচ্ছে। আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় বিদেশে রেখে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক পুঁজিপাচার দমনের জন্য যদি সময়মত সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতো তাহলে আমাদেরকে এই বেইজ্জতির সম্মুখীন হতে হতো না। তা না করে বরং সরকার ইডিএফ লোনের মাধ্যমে আরো সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের সুবন্দোবস্ত করে দিল! এটা কি নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনা নয়?
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধকনসার্টে জ্ঞান হারালেন কার্লোস সানতানা