টোকেন মূল্যে খাস জমি চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ

জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের আগামী শতাব্দীর বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বে টার্মিনালের জন্য সরকারের ৮০৩ একর ভূমি টোকেন বা প্রতীকী মূল্যে সরকারের কাছ থেকে পেতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে ভূমির মূল্য ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা নির্ধারণ করলেও এত টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে ভূমি কিনতে হলে বে টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধের পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত পেতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে।
গতকাল (বুধবার) সকালে বে টার্মিনালের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খসড়া মাস্টারপ্ল্যান উপস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় উপরোক্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণের বদলে টোকেন মূল্যে খাস জমি বরাদ্দের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে আবেদন করেছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই আবেদন প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনাধীন আছে। আবেদনটি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আবেদন বিবেচিত হলে বে টার্মিনাল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যাবে। এই প্রকল্প নিয়ে সরকারের অবস্থান ইতিবাচক জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বে টার্মিনালের ব্যাপারে আগ্রহী। সভায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (সিসিসি), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, সিএমপি ট্রাফিকের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ বে টার্মিনালের ব্যাপারে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পরামর্শদাতা হিসেবে কোরিয়ান ডাইয়িং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও কোরিয়ান কুনহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসাল্টিং কোম্পানি লিমিটেডকে যৌথভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সংস্থা দুটি ইতোমধ্যে তাদের সূচনা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করতে বিভিন্ন সংস্থা এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের দেয়া যৌক্তিক সব প্রস্তাব একত্রিত করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ৯ম পৃষ্ঠার ১ম কলাম
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান ও নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর আমরা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করব। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বে টার্মিনালের বহুমুখী কার্যক্রম শুরু করার জন্য নির্মাণ ঠিকাদার নিয়োগের কাজ শুরু করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বে টার্মিনালের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রধান মি. পার্ক জং-জিন সাংবাদিকদের জানান, এক মাসের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করে নকশা প্রস্তুত করা হবে।
উল্লেখ্য, নগরীর হালিশহর উপকূলে বন্দরের ইপিজেডের পেছনে সাগরপাড় থেকে রাসমনিঘাট পর্যন্ত প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় আড়াই হাজার একর ভূমিতে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উপকূলে জেগে ওঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে বে টার্মিনালের জন্য দেশের প্রথম ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল খনন করতে হবে। ২০১৬ সালে বে- টার্মিনাল নির্মাণের কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষায় কারিগরি ও অর্থনৈতিকভাবে এ টার্মিনাল গড়ে তোলা উপযুক্ত বলে মতামত দেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে ৬৭ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে। এতে মাটি ভরাটের কাজও শুরু হয় বেশ আগে। তবে প্রকল্পের জন্য সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত ৮০৩ একর ভূমির দাম ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়। এই জমি কেনা বা সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়ার উপরই বে টার্মিনাল বাস্তবায়নের অ্যাকশন প্ল্যান নির্ভর করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এত টাকা দিয়ে ভূমি কেনার মতো অবস্থা এই মুহূর্তে বন্দরের নেই। তাই নামমাত্র মূল্যে এই ভূমি বরাদ্দ নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন এই ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছে। ওখান থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, বে-টার্মিনাল বিদ্যমান চট্টগ্রাম বন্দরের পাঁচগুণেরও বেশি বড়। এখানে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে একটি ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কন্টেনার টার্মিনাল, একটি ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কন্টেনার টার্মিনাল এবং একটি দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। তিনটি টার্মিনালের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার। মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ টার্মিনালে জেটি থাকবে ছয়টি। বাকি দুটি টার্মিনাল সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে দক্ষ ও অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরদের অর্থায়নে নির্মাণ ও পরিচালনা করা হবে। বে-টার্মিনালে মোট ১৩টি জেটি থাকবে। বে-টার্মিনালে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি সুবিধা থাকবে। প্রকল্পের পূর্ব দিকে রয়েছে পোর্ট অ্যাকসেস রোড ও রেলপথ।
বে টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১০ থেকে ১২ মিটার ড্রাফটের ৬ হাজার কন্টেনার বহন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নোঙ্গর করা সম্ভব হবে। বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামোতে জেটিতে সর্বোচ্চ ১৮০০ একক ধারণক্ষমতার কন্টেনার জাহাজ ঢুকতে পারে। এখন বন্দরে জোয়ার-ভাটার ওপর ভিত্তি করে জাহাজগুলো জেটিতে ভেড়ে। কিন্তু বে টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টাই জাহাজ ভিড়তে পারবে।
বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল ড্রেজিংয়ের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের ঋণ অনুমোদনের আগে অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল সপ্তাহ দুয়েক আগে চট্টগ্রাম বন্দর সফর করে। এছাড়া বে-টার্মিনালের অংশীদার হতে সৌদি আরব-আরব আমিরাত-সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বে টার্মিনাল প্রকল্পে অনেকেই অর্থায়ন করতে চায় বলেও বন্দর সূত্র জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যবসায় অংশীদারি প্রদানের আশ্বাসে ৮৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ
পরবর্তী নিবন্ধঋতুপর্ণার মাথায় তিন সেলাই