টুই টুই টুই

আলী আসকর | বুধবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:২০ পূর্বাহ্ণ

টুটুল যে রুমে থাকে তার জানালার পাশে একটি জামরুল গাছ। মওসুম এলে গাছটা জামরুলে সাদা হয়ে যায়। এক মওসুমে দুই দুইবার জামরুল হয়। জামরুলগুলো কালো জামের মতো মিষ্টি না। একটু পানসে পানসে। লবণ মেখে খেলে তার স্বাদ বেড়ে যায়। তেঁতুল-লবণ-মরিচ মেখে টুটুলের মা মাঝে মাঝে ভর্তার মতো করে । তখন আর জিব্বাটাকে সামলানো যায় না।
টুই টুই টুই শব্দ করে একটি পাখি জামগাছের ছোট্ট ডালে এসে বসে। পিটপিট করে জানালার দিকে তাকায়। পাখিটা বাদামি রঙের মাথা তুলে হাসে। ঠোঁট টিপে টিপে হাসে। এই হাসিটা টুটুল দারুণ উপভোগ করে।
জামরুল গাছটার আসল মালিক টুটুলের দাদু। বছর খানেক আগে তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। গাছ-প্রেমিক ছিলেন টুটুলের দাদু। তাই টুটুলদের বাড়িতে গাছ আর গাছ।
কয়েকদিন ধরে এ বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার এসে কীসব হিসেব- নিকেশ করেন। মাপ-ঝোপ করেন। কন্ট্রাকটর এসে বারবার ফিতা টানেন। টুটুল জানে না কেন এসবকিছু হচ্ছে।
টুটুলের হাতে এখন মেলা সময়। কিছুতেই সময় কাটে না। ইশকুল নেই। স্যার নেই। লেখাপড়া নেই। করোনার ওপর মাঝে মাঝে ফুঁসে ওঠে টুটুল। করোনা কখন পাততাড়ি দেবে সে জানে না। ইশকুল থেকে খবর আসে আর কটা দিন সবুর করতে। আগের মতো সবকিছু শুরু হয়ে যাবে। আর কটা দিন যেন শেষই হয় না। কখন শেষ হবে কেউ জানে না।
দুপুরবেলা টুটুল কখনো ঘুমোয় না। আজ কেন জানি তার মাথাটা হেলে হেলে পড়ছে। মা এ বেলা ঘণ্টা দেড়েকের জব্বর একটা ঘুম দেয়। আসরের আজান পড়লে মা আড়মোড়া ভাঙে। এতো আলসে মহিলা মা!
টুই টুই টুই করে বাইরে শব্দ হয়। জানালার পর্দা ঠেলে টুটুল বাইরে তাকায়। টুটুলকে দেখে পাখিটি টুই…ই… করে ওঠে।
তুমি কেমন আছো টুটুল?
টুটুল চমকে ওঠে। পাখিটা কথা বলছে। পাখি যে কথা বলতে পারে টুটুল জনমেও দেখেনি। ও অদ্ভুত চোখে পাখিটির দিকে তাকায়। বাহারি রং তার শরীরে। কোথাও জলপাই সবুজ। কোথাও লাল খয়েরি। হলুদে মেখে আছে দুপা। এ পাখির নাম কী? টুটুল অবাকের ভেতর মজে থাকে।
পাখিটি বলে, আমি টুনটুনি। আমার নামে দুটো ট। তোমার নাম টুটুল। তোমার নামেও দুটো ট। কী মিলঝুল, তাই না?’
টুটুল টুনটুনির কথা শুনে অবাক হয়। তার নামে যে দুটি ট আছে টুটুল কখনো খেয়াল করেনি।
সে বলে, তুমি থাকো কোথায়?
ওই ওখানে। বাদাম গাছে আমার বাসা। আমি সময় পেলেই এখানে আসি। চুকচুক করে তোমাকে দেখি। কিন্তু আমার মনে এখন অনেক কষ্ট।
কষ্ট! কীসের কষ্ট?
এই জামরুল গাছটা দুদিন পরে আর থাকবে না। কেটে ফেলা হবে। তোমার আব্বু একটা বিরাট দালান বানাবে এখানে। আট-দশ তলা দালান।’
বলো কী?
সত্যি বলছি। একদম সাত সত্যি’
আমি এখন কী করবো?
আব্বুকে বলবে চারফুট বাদ দিয়ে ঘর বানাতে। তাহলে এ গাছটা আর কাটা পড়বে না। আমিও এসে বসতে পারবো। তোমাকে দেখতে পারবো।
ঠিক আছে, আব্বুকে বলবো।
টুই টুই টুই করে টুনটুনি ওড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পেছন থেকে মায়ের ডাক শোনা যায়। ঘুম ভেঙে যায় টুটুলের। টুটুল এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। রাতেও টুটুল মাঝে মাঝে আবোল-তাবোল স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ স্বপ্নটা তার কাছে অন্য রকম লাগে। আপন আপন লাগে।
টুটুল বাইরে জামগাছে চোখ ফেলে। ঝিম ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে একটি পাখি, টুনটুনি পাখি।
রাতে খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসে টুটুলেরা। টুটুল আব্বুর দিকে মুখ করে বলে, ‘জামরুল গাছটা কাটবে না, আব্বু।’
কেন কাটব না?
দাদুর লাগানো গাছ। দাদু অনেক কষ্ট পাবে। তুমি হ্যাঁ বলো। তুমি হ্যাঁ বললেই আমি খাওয়া শুরু করবো।
টুটুলের আব্বু খেতে খেতে কী যেন ভাবলেন। হয়তো তাঁর বাবার কথা মনে পড়ে গেছে। গাছগাছালির প্রতি বাবার কী মায়াটাই না ছিল।
বাবা বললেন, ঠিক আছে, গাছ কাটা হবে না।
খাওয়া শেষে টুটুল জানালার পাশে চলে গেল। টুনটুনি বসে আছে একটি ডালের শেষ মাথায়। টুটুল হাত তুলে ওকে ডাকল। সাথে সাথে টুনটুনি মহা আহ্লাদে এ-ডাল থেকে ও-ডালে ছুটোছুটি শুরু করল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাবারে কৃত্রিম রং ফ্রিজে দুর্গন্ধযুক্ত মাংস মিষ্টি
পরবর্তী নিবন্ধবৃষ্টিতে